বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাধু বাবার সেবায় নিয়োজিত ২০০ সুন্দরী!

ভোরের সংলাপ ডট কম :
আগস্ট ২৭, ২০১৭
news-image

প্রায় হাজার একর জমির মাঝখানে আয়নায় মোড়া এক প্রাসাদ। তার নাম ‘বাবা কি গুফা’। দামি আসবাব, সোফা, পর্দায় সাজানো বিলাসবহুল সেই প্রাসাদেই বাস গুরমিত রাম রহিম সিংহের।
গুফায় তাকে ঘিরে থাকেন ২০০ জনেরও বেশি বাছাই করা শিষ্যা। তাদের চুল খোলা। পরনে সাধ্বীদের মতো দুধসাদা রঙের পোশাক। এরাই রাম রহিমের যত্নআত্তি, দেখভাল করেন।
এমনই দুই শিষ্যাকে ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বাবা রাম রহিম। এক সময়ে বাবার ‘গুফা’য় অতিথি হওয়া বিহারের সাংবাদিক পুষ্পরাজ জানিয়েছেন, সেখানে আছে মেয়েদের স্কুল ‘পরীলোক’। তার সব পড়ুয়াই সুন্দরী। কারণ, বাবাজি মনে করেন ‘খুবসুরত’ হলেই মেধাবী হয়।
সেই গুফায় প্রবেশাধিকার আছে মাত্র কয়েক জনের। তাও আঙুলের ছাপ, চোখের মণি-র মতো বায়োমেট্রিক তথ্য মিললে তবেই ভিতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে।
ধর্মগুরু হলেও রাম রহিমের পছন্দ শিফনের রঙবেরঙের জামা, বাহারি জুতো। তার জামাকাপড় তৈরির জন্য নিজস্ব ফ্যাশন ডিজাইনার রয়েছেন। রয়েছেন নিজস্ব ‘হেয়ার ড্রেসার’-ও।
রাম রহিমের কনভয়ে বিলাসবহুল ১০০টি গাড়ি। তার মধ্যে ১৬টি কালো রঙের ফোর্ড এনডেভার। বাবা প্রাসাদ থেকে বের হলে সব গাড়ি তাবু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। বাবা নিজেই ঠিক করেন, তিনি কোন গাড়িতে উঠবেন। আশ্রমে নিজের ব্যাটারিচালিত গাড়িতেই ঘোরেন তিনি।
আরও পড়ুন:ভূমিশয্যায় রাম রহিম, আপাতত ক্ষান্ত ভক্তরা
সিরসায় ডেরা সচ্চা সৌদার এই সদর দফতর আসলে নিছক আশ্রম নয়। ছোটখাটো শহর। ডেরা-র ভিতরেই চাল, ডাল, আনাজের চাষ হয়। হোটেল, সিনেমা হল, স্কুল, রেস্তোরাঁ, মাল্টি-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, স্টুডিও, বায়ো-গ্যাস কারখানা, পেট্রোল পাম্প, সংবাদপত্রের ছাপাখানা— সবই রয়েছে। এক সঙ্গে ১০ হাজার জামাকাপড় কাচার ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াশিং মেশিনও রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে কন্ট্রোল রুম, গোটা ডেরা জুড়ে নজরদারি ব্যবস্থা।
ডেরা-র বাইরেও রাম রহিমের দাপট কম নয়। ডেরা সচ্চা সৌদা সিরসায় একটি নিজস্ব বাজার তৈরি করেছে। সেখানে সব দোকানেরই নাম শুরু সচ্ দিয়ে। সিরসা ছাড়াও দেশেবিদেশে আরও ৪৬টি আশ্রম রয়েছে রাম রহিমের। রাম রহিম নিজেকে ‘মেসেঞ্জার অফ গড’ বলেন। তার ‘এমএসজি’ ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু-তেল-সাবানের মতো হাজারো সামগ্রীর ব্যবসাও চলে এই আশ্রম থেকেই। আশ্রমে রাম রহিমের প্রবচন শুনতে দিনে গড়ে ৩০ হাজার লোক জড়ো হয়। মাত্র ছ’মিনিট ভক্তদের উপদেশ দেন। তার পরেই মঞ্চে ডিজে উঠে গান বাজাতে শুরু করেন।

মাত্র দু’সপ্তাহ আগেই সিরসার ডেরা-য় ‘মিউজিক্যাল কার্নিভাল’-এর আয়োজন হয়েছিল। ১২ অগস্ট রাতের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন অন্তত ৭০ লক্ষ মানুষ। মাঝরাতে মঞ্চে ওঠেন রাম রহিম। অদ্ভূতদর্শন লাল রঙের আলো ঝলমলে গাড়িতে। তার পর গান শোনাতে শুরু করেন। জলসা চলে রাত তিনটে পর্যন্ত। রাম রহিম অবশ্য শ’খানেক কনসার্ট করেছেন। বাবাজি ১৫ অগস্টেই ৫০ বছরে পা দিলেন। সেদিন ৩ ইঞ্চি মোটা, ৪২৭.২৫ বর্গফুটের কেক তৈরি হয়েছিল। তার উপরে একসঙ্গে দেড় লক্ষ মোমবাতি জ্বালানো হয়েছিল।
ধর্মগুরু রাম রহিম অবশ্য সংসারী। স্ত্রী হরজিত কউর ও তার এক পুত্র ও দুই কন্যাও রয়েছেন। এ ছাড়াও একটি কন্যা দত্তক নিয়েছেন তিনি। মেয়েরা তার সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন। ছেলে জসমিতের বিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতা হরমেন্দ্র সিংহ জস্‌সির কন্যার সঙ্গে। বড় মেয়ে চরণপ্রীতের দুই ছেলে রয়েছে। বাবাজি আদর করে নাতিদের নাম দিয়েছেন— সুইটলাক ও সুবাহ-এ-দিল।
ভূমিশয্যায় রাম রহিম, আপাতত ক্ষান্ত ভক্তরা
শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এটা ছিল খুনি-ছিনতাইবাজ-চোর-বাটপারদের মামুলি এক জেলখানা। বেশি রাতের পরে সেটাই হয়ে গেল দুর্ভেদ্য দুর্গ!
স্থান, রোহতক। সুনারিয়া জেল।
এখানেই অন্য কয়েদিদের সঙ্গে ভূমিশয্যায় রাত কাটাচ্ছে জোড়া ধর্ষণ মামলায় দোষী ধর্মগুরু, গুরমিত রাম রহিম সিংহ। কয়েদি নম্বর ১৯৯৭। কাল রাতেই পঞ্চকুলা থেকে তাকে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে আনা হয়েছে এই জেলে। তার পর থেকে গোটা চত্বর কার্যত দুর্গ। সেনা, আধা সামরিক বাহিনী এবং স্থানীয় পুলিশের তিনটি বৃত্ত ২ কিলোমিটার আগে থেকে ঘিরে রেখেছে সুনারিয়া জেলা কারাগার। ডি জি (কারা) কে পি সিংহের কথায়, ‘‘রাম রহিমের সেলের সামনে প্রহরায় রয়েছেন ৪ জন রক্ষী। কোনও বিশেষ সুবিধা তাকে দেয়া হচ্ছে না। মেঝেতেই শুচ্ছে। অন্য কয়েদিদের মতোই সাধারণ খাবার পাচ্ছে।’’
গত কাল বিপুল বিক্রমে তাণ্ডব চালিয়েছিল রাম রহিমের ভক্তরা। সকাল হতেই ভক্তি ঘুচে গেছে অনেকের! তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পথেঘাটে থিকথিকে জলপাই উর্দি আর উদ্যত ইনসাসের নল। ভক্তি ও বিক্রম ঘুচিয়ে বাকিরাও তাই আজ শান্ত। তবু পথেঘাটে সতর্ক পুলিশ। যাতে কোনও গোলমাল না হয়। একজনের কথায়, ‘‘কাল যে কী হলো!’’

ভোলবদল! নাকি অন্য কিছু?
প্রশাসনের একটা অংশ মেনে নিচ্ছে, এটা ভোলবদলই। কারণ রাম রহিম সিংহের পিছনে বরাবর পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিল হরিয়ানার বিজেপি সরকার। ৩৬টা লাশ, অসংখ্য গাড়িতে আগুন-ভাঙচুর, দেশ জোড়া সমালোচনা আর হাইকোর্টের রুদ্রমূর্তির সামনে এখন সুর পাল্টেছে হরিয়ানার মনোহরলাল খট্টারের সরকার। গোলমাল থামাতে ব্যর্থ হওয়ায় পঞ্চকুলার ডিসিপি অশোক কুমারকে সাসপেন্ড করার পাশাপাশি আদালত চত্বরে গত কাল গুরমিতের ব্যাগ বওয়ার অপরাধে বরখাস্ত করা হয়েছে ডেপুটি অ্যাডভোকেট জেনারেল গুরুদাস সিংহ সলওয়ারাকে। আরও কিছু কড়া পদক্ষেপ করা হতে পারে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে।
সে যা-ই হোক, আজ পরিস্থিতি সেনার ভাষায়, ‘বিলকুল মস্ত্!’ ভোর থেকে সিরসায় সেনা টহল দিয়েছে। গুরমিত রাম রহিমের ডেরা সচ্চা সৌদা ঘিরে রেখেছে সেনা। তবে এখনও ভিতরে ঢোকেনি। হরিয়ানা পুলিশের ডিজির কথায়, ‘‘ডেরার ভিতরে এখনও তিন-চার হাজার ভক্ত রয়েছেন। অনেকেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।’’ বিভিন্ন জায়গা থেকে ৫৫২ জন ভক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে এ কে ৪৭-এর মতো অস্ত্রও। আজ সুর নামিয়ে ডেরার চেয়ারপার্সন বিপাসনা ইনসান বলেছেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মধ্যে কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়েছিল বলেই কাল হিংসা হয়েছে।’’

bhorersanglap