বাসস্থানের সংস্থানে সফল বাংলাদেশ
রেজাউল করিম সিদ্দিকী
বাসস্থান প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে অন্যতম মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃত। আদিম যুগে মানুষ রুক্ষ প্রকৃতি ও বন্য পশুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাহাড়ের গুহা বা গাছের কোটরে বাস করতো। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে মানুষের বাসস্থানের পরিবর্তন হতে থাকে। মানুষ কৃষিকাজ, পশুপালন ও ঘরবাড়ি তৈরি করতে শেখে। ঘরবাড়ি নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত উপকরণের ব্যবহার শুরু হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে মানুষের বাসস্থানের চাহিদা। একইসাথে কমতে থাকে ব্যবহারযোগ্য ভূমির পরিমাণ। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা ৭শ কোটিরও বেশি। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ তা হবে ৯শ কোটির বেশি। এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য মানসম্মত বাসস্থান নিশ্চত করা ধনী দরিদ্র সকল দেশের জন্যই একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। উপরন্তু ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যা তো আছেই। সবমিলিয়ে সবার জন্য মানসম্মত বাসস্থান বা আবাসনের ব্যবস্থা করা সত্যিই একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্ব বসতি দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই প্রেক্ষিতে ১৯৮৬ সাল থেকে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব বসতি দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে দিবসটিকে উদযাপন করা হয়। নিরাপদ ও মানসম্মত আবাসন নিশ্চিতকরণে এ দিবস উদযাপনের তাৎপর্য অপরিসীম। এবছর দিবসটির প্রাতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে Housing For All: A Better Urban Future. বাংলায় এর অর্থ করা হয়েছে “সকলের জন্য আবাসন: ভবিষ্যতের উন্নত নগর”। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের আবাসন ব্যবস্থার জন্য এ প্রাতিপাদ্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ও যথার্থ হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের আবাসন পরিকল্পনায় নগরের প্রতিটি স্তরে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাসযোগ্যতা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আমাদের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সকল
মহানগরীর জন্য মহাপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এবারের বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্য আবাসন সঙ্কট মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ আবাসন গড়ে তোলা এবং পরিবেশ বান্ধব নগরায়নে সকলকে অনুপ্রাণিত করবে। একসময় এদেশের মানুষের গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরু ছিল। বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দে কাটতো এদেশের সাধারণ মানুষের জীবন। কালক্রমে বহি: শত্রুর আক্রমণ, প্রায় দুইশ বছরের ইংরেজ শাসন-শোষণ, তেইশ বছরের পাকহানাদার শাসকগোষ্ঠীর শোষণ নির্যাতনে এদেশের অধিকাংশ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। উপরন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, দ্রুত নগরায়ণ ও ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে বাসযোগ্য ভূমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ হয়ে পড়ে আশ্রয়হীন। তাছারা নদী ভাঙ্গন, ঘুর্ণিঝড়সহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে আরো অনেকে। সব মিলিয়ে ৫৫ হাজার বর্গমাইল ক্ষুদ্র আয়তনের এই দেশে সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা একটা বড়ো চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বাধীনতার অব্যাবহিত সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি সারাদেশের বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ঢাকার মিরপুরের বাউনিয়াবাদ এলাকায় তাদের বসবাসের জন্য জমি বরাদ্দ দেন। সমুদ্র উপকূলে ঘুর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। সরকারি কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়নেও গ্রহণ করেন নানাবিধ কার্যক্রম। সারাদেশে রাস্তাঘাট মেরামত, ব্রিজ/কাল্ভার্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেন। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গ্রহণ করেন হাজারো প্রকল্প। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে তাঁর সেই যুগান্তকারী কার্যক্রমকেও হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু দেশের আবাসন সংকট নিরসনে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ফলে ভূমিহীন উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী যেমন আবহেলিত থেকেছে, তেমনি সরকারি বেসরকারি আবাসন শিল্পের আবস্থাও ছিল রুগ্ন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের আবাসন ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ঢাকা ও চট্রগ্রাম মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে ৩৫,৩৬৫ টি প্লট উন্নয়ন এবং ৮৯১২ টি ফ্ল্যাট নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ১৮,১০৫ টি প্লট উন্নয়ন এবং ৭,৯৬০ টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। অদূর ভব্যিষতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক সারাদেশে ১৮,১৪৮ টি প্লট উন্নয়ন ও ১,৪১,৬৮৭ টি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকায় বসবাসরত বস্তিবাসীদের জন্য ৫৩৩টি ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে এবং আরও ১০,৫৩০টি টি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের জন্য ০৯টি প্রকল্পের আওতায় ৩,০৬৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। ঢাকা মহানগরীতে সরকারি কর্মচারীদের আবাসনের লক্ষ্যে ১৩ টি চলমান প্রকল্পের আওতায় ৬,৮৭৯ টি ফ্ল্যাটের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর বাইরে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে ০৪টি প্রকল্পের আওতায় ২,৮৯৬ টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আরও ০৮ টি প্রকল্পের আওতায় মোট ৮,৮৩৫ টি ফ্ল্যাট নির্মাণের অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে (জুলাই ১৯৯৭-জুন ২০০২) ৪৭২১০টি, দ্বিতীয় পর্যায়ে (জুলাই ২০২০-ডিসেম্বর ২০১০) ৫৮৭০৩টি পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের সাফল্যে ২.৫০ লক্ষ ভূমিহীন, গৃহহীন,ছিন্নমূল ও অসহায় পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে এবং এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১,৯২৩৩৬টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছে। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৬০০টি ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করেছেন। সীমিত সম্পদ, ক্ষুদ্র আয়তন ও বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে ১০ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দেওয়া হয়েছে আশ্রয় এবং তাদের জন্য কক্সবাজারের অদূরে ভাষাণচরে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবাসন খাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী এসব পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যপকভাবে প্রসংসিত হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকায় বসবাসরত বস্তিবাসীদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ অনেক দেশ মডেল হিসেবে অনুসরণ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেশের আবাসন সংকট সমাধানে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের সামনে বর্তমানে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ভিশন: ২০৪১, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ডেলটা প্ল্যান ২১০০ রয়েছে। এসব পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তাবয়ন করতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে এদেশের মানুষের কোন আবাসন সংকট থাকবে না এবং দেশ হবে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি সবার ঐকান্তিক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।