শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মুক্তির সওগাত শবেবরাত

ভোরের সংলাপ ডট কম :
এপ্রিল ২৭, ২০১৮
news-image

শাবান আরবি বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস। পবিত্র রমজান মাসে একাগ্রচিত্তে সিয়াম সাধনা ও অধ্যবসায়ের প্রস্তুতি গ্রহণের মাস। এ মাসের বরকত ও ফজিলত অনেক। এর অন্যতম কারণ, এ মাসের ১৪তম তারিখ দিবাগত রাতটি হলো সৃষ্টিলোকের মুক্তি নির্ধারণে বিশেষ ও বরকতপূর্ণ ‘শবেবরাত’ বা লাইলাতুল বরাত। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে এবং ইবাদতের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পনেরো শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং পরদিন রোজা রাখ। (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৪)।

এ মাস এলে প্রিয়নবী (সা.) স্বীয় আমলের পরিমাণ স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অধিক বাড়িয়ে দিতেন। উম্মুল মোমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, ‘একবার রাসুল (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হলো তাঁর হয়তো ইন্তেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন?… নবীজি আরও জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন।’ (বায়হাকি : ৩/৩৮২, ৩৮৩)। এই হাদিস থেকে এ রাতের ফজিলত যেমন জানা যায়, তদ্রƒপ এ রাতের আমল কেমন হওয়া উচিত তা-ও বোঝা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘ নামাজ পড়া, সেজদা দীর্ঘ হওয়া, দোয়া-ইস্তেগফার করা ইত্যাদি।

শবেবরাতে করণীয়
হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোনো রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৪)। তবে এ ক্ষেত্রে এই বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলগুলো, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকী করণীয়। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে জামাতে আদায় করতে হবে। নফল মুস্তাহাবের প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে ফরজের প্রতি যেন সামান্যতম অবহেলাও না হয়।

শবেবরাতে বর্জনীয়
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শবেবরাত একটি পুণ্যময় রজনী হওয়া সত্ত্বেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তাতে এমন কিছু কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। অন্যথায় এসব কার্যাবলি আমাদের ইহ ও পরকালের জীবনে কল্যাণ ও মুক্তির পরিবর্তে অকল্যাণ ও বিপদ বয়ে আনবে। যেমনÑ আতশবাজি, হালুয়া-রুটির বিশেষ আয়োজন, প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকসজ্জা, মাজারে বা কবরস্থানে মেলা উৎসব করা, একাগ্রতার প্রতি লক্ষ্য না দিয়ে বাহ্যিক জাঁকজমকের দ্বারা অনুষ্ঠানসর্বস্ব করে তোলা, হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন বদলানো, অলিলগলিতে ঘোরাফেরা ও হৈ-হল্লা করা ইত্যাদি।

শবেবরাতে ক্ষমার অযোগ্য যারা
এ রাতে দয়াময় আল্লাহ অসংখ্য মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে দিলেও খাঁটি অন্তরে তওবা না করা পর্যন্ত নিম্নবর্ণিত অপরাধীদের ক্ষমা করবেন না বলে বিভিন্ন রেওয়ায়াতে উল্লেখ রয়েছে।
১. মুশরিক, ২. জাদুকর, ৩. গণক, ৪. হিংসুক, ৫. গায়ক-গায়িকা, ৬. যারা বাদ্যযন্ত্র বাজায় ও বানায়, ৭. রেখা টেনে ফালনামা দেখে ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী, ৮. আত্মীয়তা ছিন্নকারী, ৯. পরস্পর শত্রুতা পোষণকারী, ১০. জালেম শাসক ও তার সহযোগী, ১১. মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী, ১২. পায়ের গিরার নিচে গর্বসহকারে জামা পরিধানকারী, ১৩. মদ্যপ, ১৪. পরস্ত্রীগামী, ১৫. মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, ১৬. কৃপণ, ১৭. পরনিন্দাকারী, ১৮. অন্যায়ভাবে শুল্ক আদায়কারী।
এ ছাড়া আরও অনেক অপরাধীর কথা বর্ণিত হয়েছে, যার সব ক’টি গোনাহে কবিরা। শবেবরাত ও শবেকদরের বরকতে সগিরা গোনাহ মাফ হয় বটে, তবে কবিরা গোনাহ থেকে ক্ষমা পেতে হলে খাঁটি মনে তওবা করা আবশ্যক।

লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা, ঢাকা

bhorersanglap