শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রাজধানীর কোরবানির পশুহাট যেভাবে সিন্ডিকেটের দখলে

ভোরের সংলাপ ডট কম :
আগস্ট ২৫, ২০১৭
news-image

রাজধানীর কোরবানির পশুহাটগুলো সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে। ফলে দফায় দফায় টেন্ডার আহ্বান করেও কাক্সিক্ষত দর পাচ্ছে না সিটি করপোরেশন। এমনকি কোনো কোনো হাটে দরপত্রই জমা দেয়া হচ্ছে না। একান্ত বাধ্য হয়ে যাতে কম মূল্যেই সিটি করপোরেশন হাট ইজারা দিতে বাধ্য হয় সে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এতে বিপুল রাজস্ব হারাতে বসেছে সরকার। এ দিকে তৃতীয় দফায়ও কাক্সিক্ষত দর না পাওয়ায় ও জনভোগান্তির কথা চিন্তা করে আরমানিটোলার হাট বাতিল করেছে ডিএসসিসি।

আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীতে বসতে যাওয়া পশুরহাটের প্রায় সবই দখলে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণ ইজরাদাররা দরপত্রই কিনতে পারেননি। দু-একজন কিনলেও ভয়ে জমা দেননি বা দিতে পারেননি। ফলে প্রভাবশালী চক্র পছন্দ মতো দর দিয়ে হাটগুলো ইজারা নিয়েছে। আবার কয়েকটি হাটের ক্ষেত্রে কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি। সেগুলো অতীতের মতো ঈদের আগ মুহূর্তে দলীয় লোকদের দিয়ে পরিচালনা করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কয়েকটি স্থানে হাট বসানোর পরিকল্পনাই বাদ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সাধারণ ইজারাদাররা মনে করেন, এসব স্থানেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এ বছর মোট ১৩টি কোরবানির পশুহাট স্থাপনের টার্গেট নেয়। হাট হলো- খিলগাঁও মেরাদিয়া বাজার, উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারসংলগ্ন মৈত্রী সঙ্ঘের মাঠ, ব্রাদার্স ইউনিয়নসংলগ্ন বালুর মাঠ, কমলাপুর স্টেডিয়ামের আশপাশের খালি জায়গা, ঝিগাতলা হাজারীবাগ মাঠ, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ, কামরাঙ্গীরচর ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধসংলগ্ন জায়গা, আরমানিটোলা খেলার মাঠ ও আশপাশের খালি জায়গা, ধূপখোলা ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব মাঠ, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসংলগ্ন খালি জায়গা, দনিয়া কলেজ মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, শ্যামপুর বালুর মাঠ ও সাদেক হোসেন খোকা মাঠসংলগ্ন ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল ও সংলগ্ন খালি জায়গা।

এ জন্য গত ২৬ জুলাই পর্যন্ত প্রথম দফা দরপত্র জমা নেয়া হয়। কিন্তু প্রথম দফা দরপত্রে ধূপখোলা ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব মাঠ ও সাদেক হোসেন খোকা মাঠসংলগ্ন খালি জায়গায় স্থাপিত হাটের বিপরীতে কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি। এ ছাড়া সরকারি মূল্য (হাটের গত তিন বছরের ইজারা মূল্যের গড়) ঘোষিত থাকলেও গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়নসংলগ্ন বালুর মাঠ, কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন হাট এবং আরমানিটোলা হাটের বিপরীতে দরপত্রে কম মূল্য দেয়া হয়।

ফলে এ পাঁচটি হাটের জন্য দ্বিতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করে ডিএসসিসি। কিন্তু এবারও সাদেক হোসেন খোকা মাঠের জন্য কোনো দরপত্র জমা দেয়া হয়নি। বাকি চারটির মধ্যে শুধু ধূপখোলা ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব মাঠের হাটের জন্য মাত্র ২১ হাজার ২৫০ টাকা বেশি মূল দেয়া হয়। ফলে এটা হাজী মো: শামসুজ্জোহা নামে একজনকে ইজারা দিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় দফায়ও কম মূল্য দেয়ায় তৃতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করতে বাধ্য হয় সিটি করপোরেশন। কিন্তু তৃতীয় দফা দরপত্রেও চারটি হাটেই সরকারি মূল্য থেকে কম মূল্য দিয়েছে ইজারায় অংশগ্রহণকারীরা। এ ছাড়া প্রতিটি হাটেই মাত্র দুইজন করে দরপত্রে অংশ নিয়েছেন। সাদেক হোসেন খোকা মাঠে প্রথম দুই দফায় কোনো দরপত্র জমা না পড়লেও তৃতীয় দফায় এসে হারুন-অর রশীদ নামে একজন সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন ৬৮ লাখ টাকা, যার সরকারি মূল্য এক কোটি ১২ লাখ ১২ হাজার ৯১৬ টাকা থেকে ৪৪ লাখ ১২ হাজার টাকা কম।

আর এ হাটের জন্য জাফর আহমেদ নামে আরেকজন দর দিয়েছেন ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬ টাকা। আরমানিটোলা খেলার মাঠ ও আশপাশের খালি জায়গা নিয়ে গঠিত হাটের বিপরীতে দ্বিতীয় দফার টেন্ডারে ইংলিশ রোডের আশিকুর রহমান সর্বোচ্চ দর দিয়েছিলেন এক কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যা সরকারি মূল্যের থেকে তিন কোটি ৫২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা কম। তৃতীয় দফায় তিনি দরপত্রেই অংশই নেননি।

এ হাটের বিপরীতে তৃতীয় দফায় দুইজন অংশ নেন। সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন কে পি ঘোষ স্ট্রিটের এরফান এন্টারপ্রাইজের জাহাঙ্গীর আলম। তিনি দর দেন এক কোটি ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার ৭৫০ টাকা। আর সিদ্দিক বাজারের মীর মাহবুব রনি দর দিয়েছেন এক কোটি ৩৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৮০ টাকা। ফলে এ হাটে সরকারি মূল্য চার কোটি ৮৬ লাখ ৩৬ হাজার ৬৭০ টাকা থেকে কম দর উঠেছে তিন কোটি ৫০ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকা।

একইভাবে কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন হাটের সরকারি মূল্য ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৩ টাকা হলেও আমের খান দর দিয়েছেন মাত্র ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা সরকারি মূল্যের চেয়ে ৩২ লাখ ১৬ হাজার ১৭৩ টাকা কম। এ হাটের জন্য নাজমুল হক নান্না নামে আরেকজন দর দিয়েছেন ১৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়নসংলগ্ন বালুর মাঠের হাটের সরকারি মূল্য এক কোটি চার লাখ ৩৯ হাজার ৪২৭ টাকা। দ্বিতীয় দফায় সৈয়দ মাসুম আলী সর্বোচ্চ দর দিয়েছিলেন ৬২ লাখ টাকা। তৃতীয় দফা দরপত্রেও তিনিই সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন ৬২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর রহিম আহমেদ নামে আরেকজন দর দিয়েছেন ৪৯ লাখ টাকা। ফলে এ হাটে ৪২ লাখ ১৯ হাজার ৪২৭ টাকা কম দর উঠেছে।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ও হাটবাজার ইজারা কমিটির সদস্যসচিব মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী  বলেন, তৃতীয় দফা দরপত্রেও চারটি হাটের কাক্সিক্ষত দর না ওঠায় হাটবাজার নীতিমালা-২০১১ অনুযায়ী এর মধ্যে তিনটি হাটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। আর আরমানিটোলা খেলার মাঠের হাটটি নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের আপত্তি থাকায় জনদুর্ভোগ এড়াতে এ হাটটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা তাদের পলিসি অনুযায়ী কাজ করে থাকেন। এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এ বছর ৯টি হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে সাতটি হাটের ইজারাদার চূড়ান্ত হয়েছে। বনরূপা ও আশিয়ান সিটির পশুহাটের ইজারা চূড়ান্ত হয়নি। বনরূপার হাটে ৫১ লাখ এবং আশিয়ান সিটির হাটে ৫৩ লাখ টাকা সর্বোচ্চ দর পাওয়া গেছে।

কাক্সিক্ষত দর না পাওয়ায় এ দু’টি হাটের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ও হাটবাজার ইজারা কমিটির সদস্যসচিব আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে হাট দু’টির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পশুহাটের দরপত্র আহ্বানের পর আফতাবনগর হাটের বিপরীতে মাত্র তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। হাটটি পেয়েছেন বাড্ডার আনন্দনগরের আবদুল আউয়ালের ছেলে আবদুর রহমান রুবেল। তিনি আগে বাড্ডা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবলীগ করেন।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, সাধারণ ইজারাদারদের দরপত্র কিনতে বাধা দিয়ে প্রভাবশালী চক্র পছন্দমতো দরে ইজারাও পেয়েছেন। তবে ইজারাদারদের সূত্রে জানা যায়, আবদুর রহমান রুবেল ইজারা পেলেও বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ সবাই মিলেমিশে হাটের লাভের অংশ ভাগ করে দেন।

ডিএনসিসির ইজারা দেয়া হাটের মধ্যে ইজারাদারদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত বলে জানা যায়। কয়েকজন পদধারী নেতাও আছেন। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর গোলচত্বরসংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি ইজারা পেয়েছেন দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো: শফিক। সম্প্রতি ডিএনসিসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া দক্ষিণখানের একটি ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগ থেকে কাউন্সিলর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ভাটারার হাট ইজারা পেয়েছেন ক-৮১ শাহজাদপুরের বাসিন্দা গুলশান থানা আওয়ামী লীগের নেতা মোজাফফর হোসেন।

মোহাম্মদপুরের বসিলা পুলিশ লাইন্সের জায়গার হাট পেয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সহসভাপতি মো: শাহ আলম। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গার হাট পেয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাহউদ্দিন মাহমুদ। মিরপুরের ডিওএইচএস সংলগ্ন উত্তর পাশের খালি জায়গা পেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপি এখলাস উদ্দিন মোল্লার ছেলে ইমরান উদ্দিন মোল্লা।

bhorersanglap