বৃহস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আমাদের রাজনীতিবিদগণ ও সুইস ব্যাংকের টাকা

ভোরের সংলাপ ডট কম :
জুলাই ১, ২০১৭
news-image

আমাদের রাজনীতিবিদগণ ও সুইস ব্যাংকের টাকা

চিররঞ্জন সরকার : আমাদের রাজনীতিবিদগণ ও সুইস ব্যাংকের টাকা সুবিখ্যাত সুকুমার রায় ‘খুড়োর কল’ নামক কবিতায় এক আশ্চর্য কল বা যন্ত্রের কথা বলেছিলেন। যে যন্ত্র ঘাড়ের কাছে লাগালে ওই খুড়োর ‘খাই খাই’ স্বভাব বেড়ে যায় এবং সে যা পায় তাই খেতে থাকে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ নেতা ওই খুড়োর কল নীতিই মেনে চলেন।
ভোটার নামে পরিচিত ‘গাধা’গুলোর মুখের সামনে প্রতিশ্রুতির মুলো ঝোলালেই এরা দৌড়ে এসে ভোট দিয়ে যায়। অনেক সময় আবার ভোটের দরকারও হয় না। এমন এক কল ফিট করা হয় যে ভোট ছাড়াই ‘নির্বাচন’ হয় এবং সেই নির্বাচনের সংসদ কাজও করে!
তারপরও দেশে মাঝে মাঝে ভোটের তোড়জোড় হয়। রাজনৈতিক দলগুলো থেকে কিছু ব্যক্তি নমিনেশন ‘বাগিয়ে’ নেয়। তবে এখন রাজনীতি যেহেতু বৃহৎ ব্যবসা ছাড়া আর কিছু নয়, তাই জনগণের ভোটের ভরসায় কেউ ভোটে দাঁড়ায় না। প্রার্থীর ভোট ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পপতিরা।
বেশিরভাগ সময়ই সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ শিল্পপতি বা শিল্পগোষ্ঠী বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। বড় বড় ব্যবসা তারাই করে। অনেক সময় প্রচলিত নিয়ম-নীতি অগ্রাহ্য করলেও তাদের শাস্তি হয় না। তাদের বড় বড় অর্ডার পেতেও অসুবিধা হয় না।
অবশ্য সাধারণ মানুষ এসব জানতে পারে না। আর জানবেই বা কি করে? বাজারের যা পরিস্থিতি, চালের যা দাম, তাতে দুবেলা খাবার জোটাতেই হিমশিম, সেখানে চিন্তা করা তো বিলাসিতা! আর সবাই যদি চিন্তা করতে বা ভাবতে শুরু করে তাহলে রাজনীতিকদের তো কপাল পুড়বে! এটাও একটা নীতি যে সাধারণ মানুষকে সব সময় রুটি-রুজির সমস্যায় জর্জরিত করে রাখা!
ভাবার জন্য রয়েছেন মন্ত্রীরা। মন্ত্রীদের প্রধান ভাবনা কীভাবে চাকরিটা টিকিয়ে রাখা যায় আর মাল কামানো যায়! একবার মন্ত্রী হতে পারলে খাওয়া-পরার অভাব তো আর রইল না! সঙ্গে দেদার বিলাসিতা। শুধু কি নিজের? একই সঙ্গে আগামী কয়েক প্রজন্মের বসে খাবার ব্যবস্থাও পাকা করা চাই।
তারা জনগণের কথাও ভাবেন, কী করে জনগণকে ভুলিয়ে শান্ত রাখা যায়, কী করে পরবর্তী ভোটেও তাদের ভোটটা নিশ্চিত করা যায়। জনগণের জন্য কোন কাজটা করলে (মানে সেই খুড়োর কলের মুলো) জনগণ খুশি থাকবে এবং লাভের অঙ্কও অনেক বেশি হবে, তেমন কাজ তারা কিছু করেন বটে।
ধরা যাক কোনো এক জায়গায় রাস্তা নেই, সেখানে রাস্তা বানানো হলো। ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার কাজের ভার পেল। জনগণ রাস্তা পেয়েই খুশি। সে রাস্তা ভালো না খারাপ, কত খরচ-এসব অসাধারণ ব্যাপার তো আর সাধারণের জানার কথা নয়! জনগণ খুশি, ঠিকাদার লাভের অঙ্ক বুঝে নিয়ে খুশি, আর মন্ত্রী বা এমপি এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দ্বিগুণ খুশি। একটা পাখি জনগণ কে খুশি রাখা, আরেকটা ঠিকাদারের কাছে লাভের অংশ বুঝে নেওয়া। এটা একটা অতি সামান্য উদাহরণ মাত্র।
রাজনীতির ব্যবসায় এই হলো সুবিধা, যতদিন গদিতে, লোকসানের কোনো ভয় নেই, বিনা ইনভেস্টে শুধু লাভ আর লাভ। ভয় শুধু একটাই একদিন অন্য কাউকে এই ব্যবসার ভার ছেড়ে দিতে হবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও। এই ভয়েই জনগণের জন্য ভাবনাটা আসে, কি করলে গাধাগুলো আবার তাকেই ভোট দেবে। সে জন্যই তো নিরন্তর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আবার বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে তাদের প্রধান ও প্রথম কাজ হয় আগে যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের দুর্নীতিগুলো খুঁজে বের করা। এর প্রধান উদেশ্য জনগণকে বোঝানো- আমরা সৎ, দুর্নীতিপরায়ণদের আমরা ছাড়ব না। আর জনগণ আগের দলের দুর্নীতির খবরে ব্যস্ত থাকলে, নতুন ক্ষমতায় আসা দলের দিকে নজর কম দেবে। ফলে নিশ্চিন্তে কামানো যাবে। গত চারদশক ধরে আমাদের দেশে এই ধারাই চলছে।
সত্যজিৎ রায় ভালো চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি রাজনীতিটাও ভালো বুঝতেন। ছোটদের সিনেমার মোড়কে কি দারুন রাজনৈতিক সিনেমা উপহার দিয়ে গেছেন- ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘হীরক রাজার দেশে’! ছোটবেলায় দেখা এসব সিনেমা এই বড়বেলায় আরও অনেক বেশি প্রিয় হয়ে গেছে-‘ও মন্ত্রীমশাই…, ষড়যন্ত্রী মশাই…’ বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে কি নিদারুণ সত্যি একটা লাইন!
আমাদের রাজনীতির মূল বিষয় কিন্তু মোটেই জটিল কিছু নয়। যে কোনো মূল্যে ভোটে জেতা আর ভোটে জিতে ক্ষমতায় দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য যত রকম নোংরা কাজ আছে করে যাওয়া। এটাই এক এবং একমাত্র কৌশলে পরিণত হয়েছে। দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয়ে চলেছে এই নীতিকে সামনে রেখে। এর বাইরে দেশসেবা কথাটা-সেই খুড়োর কল!
ভোটের প্রচারে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দেয় ভুরি ভুরি। তাদের সবচেয়ে বেশি ঝোঁক, প্রতিপক্ষ দলগুলোর নামে বিষোদগার করা। নিজের দুর্নীতি আর ব্যর্থতার কথা তারা বেমালুম চেপে যায়। আর জনগণও অত্যন্ত সরেস। ঘুরে ফিরে সেই একই নেতানেত্রীদের চরণতলে তাদের আনুগত্য ঘোষণা করে যায়! সে যতো খারাপই হোক (তাইতো নিজামী-মওদুদ-সাকা চৌধুরীরাও আমাদের দেশে যুগের পর যুগ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন)!
আজ পর্যন্ত এমন উদাহরণ খুব কমই দেখা গেছে যে, দুর্নীতির কারণে জনগণ কোনো নেতা বা নেত্রীকে ভোট দেয়নি! অদ্ভুত এই দেশ! এদেশে মেধাবী হয়েও চাকরি পাওয়া যায় না, কিন্তু একজন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত অপরাধী ব্যক্তিও কোনো মতে মন্ত্রী হয়ে অনেকের চাকরি দিতে পারেন। একটা ভালো কাজ তা সে যে দলই করুক, সমস্ত রাজনৈতিক দল সেটা সমর্থন করে প্রশংসা করেছে, এমন দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তিরা চান না যে তার দলের সবচেয়ে সৎ ব্যক্তিটি মন্ত্রী হোক। যদিওবা হয়, তাহলে সবাই মিলে তাকে অযোগ্য-অথর্ব বানিয়ে দেওয়া হয়। সে কোনো কাজই করতে পারে না, তাকে করতে দেওয়া হয় না। বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিতে সততা বা সৎ মানুষের কোনো ভাত নেই।
এদেশের মানুষকে নিয়ে প্রহসনের কোনো শেষ নেই। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো বিজ্ঞাপন। রেডিও-টিভিসহ গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে নিরন্তর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে উপহাস করা হয়। যদিও এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবু একটু বলা দরকার।
যে দেশে বেশিরভাগ মানুষের দুবেলা খাওয়া জোটে না, অনেক মানুষ ফুটপাতে রাত কাটায়, সেখানে দুধ, স্ট্রবেরি, আপেল, পিচ ইত্যাদি দামি ফলের তৈরি তথাকথিত রং ফর্সা করার মুখে মাখার ক্রিম বা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন কিংবা দামি মোবাইল সেট, টিভি ফ্রিজের বিজ্ঞাপন নিদারুণ উপহাস বা ব্যঙ্গ ছাড়া কি?
রাজনৈতিক নেতাদের বিজ্ঞাপনও একটা বড় প্রহসন। ভোটের প্রচারে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। সভা, মিছিল, লিফলেট, পোস্টার দেয়াল লিখন, বিলবোর্ড, জনদরদি নেতাদের বড় বড় কাট আউট আরও কত কি!
এটাও কি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চরম উপহাস নয়? এই যে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়, এটা দিয়েও জনগণের জন্য অনেক কিছু করা যায়। এলাকায় লাইব্রেরি স্থাপন, পুকুর সংস্কার, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়ন দরিদ্রদের পুনর্বাসন আরও কতো কি আছে করার!
কিন্তু তা না করে, টাউট-বাটপারদের নগদ টাকা দিয়ে, প্রচারের নামে নগদ টাকা পানিতে ঢেলে এক আজব অপচয়ের পথে রাজনীতি আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। আর এই টাকা খরচ কে করে, কেন করে, এই টাকা ওঠে কি করে-সবই কিন্তু জনগণকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লুট করেই হয়।
আসলে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা (দুচারজন ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন) লুটপাট আর নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া আর কিছুই করেন না। নিজেরা প্রতিনিয়ত যে দেশকে ‘ধর্ষণ’ করে চলেন অথচ সাধারণ মানুষের দেশপ্রেমের আবেগকে জিইয়ে রাখেন রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য। তাই ভোটের আগে এই দেশপ্রেমকেও উসকে দেওয়ার চেষ্টা হয়।
রাজনীতিবিদ নামক ব্যবসায়ীদের এই লুটপাটের টাকা কোথায় যায়? এই লুটপাটের টাকা সবার অলক্ষে চলে যায় সুইস ব্যাংকে। কিছু লোক ফুলেফেঁপে কলাগাছ হয়। তাদের আয় বাড়ে। সেই আয়ের হিসেবে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ে। শাসকরা উল্লসিত হন। আর এই ধনিকগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপী বিভিন্ন দেশের শাসকরা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সাব্বাসী দেন।
‘বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে’ বলে জিগির তোলেন। কিন্তু বৈষম্যের শিকার, লুটপাটের শিকার, দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হওয়া মানুষগুলো কোনো দিশা পায় না। দেশের এই তথাকথিত প্রবৃদ্ধি গরিবের সমৃদ্ধি আনার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাই রাখে না। রাখবে কি করে? লুটপাটকারীদের টাকা তো দেশেও বিনিয়োগ হয় না।
আমাদের দেশের জনগণের টাকা দেশে যত না তার থেকে বেশি আছে সুইস ব্যাংকে! আর আমরা গাধার দল ডাকাতের দলকে বিশ্বাস করে তাদের হাতে নিজেদের সর্বস্ব তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে সুখে জীবন কাটাতে চাইছি!
হ্যাঁ, এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। বিকল্প চাই। এক লুটপাটকারীর বদলে আরেক লুটপাটকারী নয়, সত্যিকার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজটা এখনই শুরু করতে হবে। নেতৃত্ব দিতে হবে তরুণদেরকেই।
তা না হলে ফি বছর সুইস ব্যাংকে টাকার পরিমাণ বাড়বে। আমরা নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব হবো!
চিররঞ্জন সরকার : লেখক, কলামিস্ট।

bhorersanglap

আরও পড়তে পারেন