বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘যে কোনো জয়ই আমাদের জয়’!

ভোরের সংলাপ ডট কম :
জুন ১৭, ২০১৭
news-image

 

গোলাম মোর্তোজা : বিজয়ের পরে যা শ্রুতিমধুর, পরাজয়ের পর তা দুর্বিষহ। বলছি ক্রিকেট বিশ্লেষণের কথা। আমিও তা করছি না। তবে কথা বলব, ক্রিকেটের জয়- পরাজয় নিয়েই। মূল প্রসঙ্গে আসার আগে প্রাসঙ্গিক কারণেই, একটু কাশ্মীর থেকে ঘুরে আসি।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভূমি কাশ্মীরের প্রকৃতি, সিন্ধু নদীর পাশ দিয়ে সাপের মত এগিয়ে যাওয়া ভয়ঙ্কর সুন্দর বরফ ঢাকা সোনমার্গের পথের বর্ণনা দেব না। বরফের মাঝে বসবাসকারী কাশ্মীরিদের জীবনকাহিনী শোনাব না।
পৃথিবীর অন্যতম সেরা জাফরান, মাইলের পর মাইল সেই জাফরান ক্ষেতের কথাও বলব না। কে মোজাহিদ, কে বিচ্ছিন্নতাবাদী, ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধের জন্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠা কারগিল পাহাড় বা যুদ্ধ- সংগ্রামের গল্পও এই লেখার বিষয় নয়।
কাশ্মীরের বিখ্যাত আপেল বাগানে যাব, তবে আপেল নিয়ে কথা বলব না। কথা বলব শ্রীনগরের বিশাল আপেল বাগানে কর্মরত এক কাশ্মীরি যুবকের সঙ্গে। বছর তিনেক আগের ঘটনা।
আপেল বাগানের আপেল দেখে মুগ্ধ হওয়ার আগেই, কাশ্মীরি যুবকের প্রশ্ন-
‘কোলকাতা?’
না, বাংলাদেশ।
‘ওহ, বাংলাদেশ! মাশরাফি, সাকিব…। মাশরাফি খুব ভালো বল করে, সাকিব খুব ভালো খেলে।’
কোলকাতার অনেক মানুষ কাশ্মীরে বেড়াতে যায়। ফলে কাশ্মীরের অনেকেই টুকটাক বাংলা বোঝে, বলতে পারে। এই যুবক কথা বলছিলেন, বাংলা- হিন্দি – ইংরেজি মিলিয়ে।
বাংলাদেশের খেলা দেখেন?
‘হ্যাঁ, দেখি। বাংলাদেশকে সমর্থন করি।’
ভারত- বাংলাদেশ খেলা হলে কাকে সমর্থন করেন?
‘বাংলাদেশ।’
ভারতকে নয়?
‘না, ভারতকে পছন্দ করি না।’
পাকিস্তান – ভারত খেলায়?
‘পাকিস্তান।’
বাংলাদেশ – পাকিস্তান খেলায়?
‘পাকিস্তান।’
পাঁচ ছয় দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেক কাশ্মীরিদের মানসিকতা এমন। তারা বাংলাদেশকে সমর্থন করেন, ভারতকে সমর্থন করেন না বলে। ভারতের প্রতি তাদের তাব্র ক্ষোভ- ঘৃণা। তারা মূলত পাকিস্তানের সমর্থক। তা শুধু খেলায় নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে।
তারা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করছেন, পাকিস্তান তাদের সহায়তা করছে। যদিও অনেক কাশ্মীরি জানেন, পাকিস্তানের অবস্থা আরও খারাপ। পাকিস্তানের সঙ্গে গেলে বা থাকলে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হতো, হবে।
তারপরও প্রায় সব কাশ্মীরি ভারতকে অপছন্দ করেন, পছন্দ করে পাকিস্তানকে।
এবার মূল প্রসঙ্গ মানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
বাংলাদেশ-ভারত খেলা নিয়ে তো কত কিছু হয়ে গেল। তারপর এখন চলছে অসহ্য বিশ্লেষণ।
খেলার আগে দুই দেশের সমর্থকদের একটা অংশ অত্যন্ত অসুস্থ ধারার কূ-তর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন অনলাইনে। অনেকে এমন ধারা থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন।
তাদের অনেকের লেখা থেকে ঠিক বোঝা যায়নি, তারা কোন দেশের বিজয় প্রত্যাশা করছেন।
বাংলাদেশের খেলা পৃথিবীর যে কোনো দেশের সঙ্গে হোক, বাংলাদেশের সব মানুষ বাংলাদেশের জয় চাইবেন-এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। একজন ভারতীয় ভারতের, পাকিস্তানি পাকিস্তানের জয় চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। কিন্তু সব কাশ্মীরি ভারতকে সমর্থন করছেন না। বেলুচিস্তানের যুবকরাও হয়ত সমর্থন করছেন না পাকিস্তানকে। হয়ত কারণ উভয় ক্ষেত্রে একই, নিপীড়ন-নির্যাতন । পাকিস্তানিরা যা করেছিল আমাদের উপরে।
কিন্তু বাংলাদেশের কিছু মানুষ কেন, বাংলাদেশকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে নানা কৌশলের আশ্রয় নেন। বাংলাদেশকে সমর্থন না করে, প্রতিপক্ষকে সমর্থন করছেন। সরাসরি করতে পারছেন না, কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। যদিও বাংলাদেশ- পাকিস্তান খেলায়, দু’একজনকে সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন করতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। কৌশলে পাকিস্তান সমর্থন করা মানুষ তো এদেশে কম নেই, প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ হলেও।
এমন সমর্থনের বিষয়ে যারা ইতিপূর্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, এবার তাদের কৃতকর্ম নিয়েও বেশ বড় রকমের প্রশ্ন তৈরি হলো। এমন নয় যে তারা নির্যাতিত- নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অংশ। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীরই মানুষ।
বাংলাদেশ-ভারত খেলা নিয়ে দর্শকদের সুস্থধারায় ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে একজনের লেখার একটি লাইন এমন-
‘যে কোনো জয়ই আমাদের জয়।’
খেলা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের। সেখানে ‘যে কোনো জয়ই আমাদের জয়’ মানে? ভারত জিতলে সেটা আমাদের জয় হবে কীভাবে?
প্রশ্নের উত্তর দিলেন এভাবে-
‘আমি অবশ্যই বাংলাদেশের বিজয় চাইছি। এবং মনে প্রাণে বিশ্বাসও করি যে বাংলাদেশ জিতবে, যা আগের স্ট্যাটাসেও বলেছি। কিন্তু শেষ লাইনটি দিয়ে বোঝাতে চাইছি যে, সেটা যদি না-ও হয়, আমাদের ভক্তরা যেনো ধৈর্য্যহারা না হন।’
যে কোনো জয়ই আমাদের জয়’ লাইনটি দিয়ে তা বোঝায় না।
এরপর তিনি লিখলেন-
‘‘আমি বোঝাতে না পারার জন্যে দুঃখিত। তাই লাইন শেষে যোগ করেদিলাম, ‘উপমহাদেশের জয়’।’’
উপমহাদেশ বিবেচনায় ভারত- পাকিস্তান আমাদের গুরুত্ব দেয় না। এসব কোনো কথা না। বাংলাদেশের সঙ্গে যে কারও খেলায়, অবশ্যই বাংলাদেশের জয় চাই। এখানে ‘যে কোনো জয়’ বলে কোনো কথা থাকতে পারে না।
এরপর তিনি আর কিছু লেখেন নি।
তার মূল লেখায় লাইনটি সংশোধন করেছেন এভাবে-
‘যে কোনো জয়ই আমাদের জয়, উপমহাদেশের জয়।’
খেয়াল করে দেখেন, এই লেখক প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের জয়ের কথা বললেও তার মূল লেখায় তিনি ‘উপমহাদেশ’র জয়ে খুশি হতে চাইছেন। সরাসরি বাংলাদেশের জয় চাইছেন না। লেখার ধরণ দেখলে মনে হয় ‘উপমহাদেশ’ আলাদা কোনো দেশ। তিনি, আমরা সেই দেশের নাগরিক। সেই দেশের বিজয়কে আমাদের বিজয় মনে করতে হবে! বাংলাদেশ পরাজিত হলেও, ভারত জয়ী হওয়ার পরও ভাবতে হবে ‘জয়’ আমাদেরই হয়েছে!
আপনি ভাবতেই পারেন, এটা একজনের ব্যাপার- ছোট একটি ঘটনা। এত গুরুত্ব দেওয়ার দরকার কী?
আমার বিবেচনায়, একজনের ব্যাপার বা ছোট ঘটনা নয়। এটা বড় ঘটনা এবং ১৬ কোটি মানুষের ব্যাপার। এমন প্রকৃতির মানুষ দেশে একজন দু’জন নয়, অনেক আছে। তারা কেউ পাকিস্তানকে সমর্থন করে, কেউ ভারতকে সমর্থন করে। পাকিস্তানকে রাজনৈতিক কারণে, ১৯৭১ সালের কারণে আমরা অপছন্দ করি। ভারতের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে অপছন্দের ব্যাপার নেই।
ভারত-অস্ট্রেলিয়া বা পাকিস্তান-ভারত খেলায় আমি ভারতকে সমর্থন করব। আবার ভারত-ওয়েষ্ট ইন্ডিজ খেলায় ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে সমর্থন করব। যে কেউ যে কোনো দলকে সমর্থন করতে পারেন, প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ না হলে।
খেলাটি বাংলাদেশের সঙ্গে হলে, ‘পাকিস্তান-ভারত বা উপমহাদেশ’ বলে কূ- কৌশলে যে দেশেরই সমর্থন করেন না কেন, সেটা বড় মাপের অপরাধ।
একজন বাংলাদেশি আমেরিকান, বাংলাদেশ-আমেরিকা খেলায় বাংলাদেশকেই সমর্থন করেন, যদিও আমেরিকা তার জীবনে সমৃদ্ধি দিয়েছে। আর আপনি আপনারা যারা বাংলাদেশকে সমর্থন না করে সরাসরি বা কৌশলে ভারতকে সমর্থন করছেন, পাকিস্তানকে সমর্থন করছেন-অপরাধ করছেন। আপনার আপনাদের উচিত জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পরিচয় ব্যবহার না করা।
গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

bhorersanglap