শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি

ভোরের সংলাপ ডট কম :
জুন ১৭, ২০১৭
news-image

দলীয় নেতাদের আলোচনার ভিত্তিতে ইতিবাচক রাজনীতির পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, সিনিয়র নেতাদের পরামর্শেই গত ১৪ জুন বুধবার ধানের শীষের পক্ষে ভোট চেয়েছেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

বিএনপি আগামী জুলাই মাসে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপেও যোগ দেবে। এর প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।

 

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন  বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এ কথা আমরা কখনো বলিনি। বলেছি, সহায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই যাব। সহায়ক সরকারের প্রস্তাব নির্বাচনে যাওয়ার জন্যই দেওয়া হবে; অর্থাৎ বিএনপি নির্বাচনের পক্ষে। তবে সরকারের এটা মনে করা ঠিক হবে না যে দাবি পূরণ না করলেও বিএনপি নির্বাচনে যাবে। ’ তিনি জানান, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সব প্রস্তুতিই বিএনপি নিচ্ছে। তবে সরকার কোনো দাবি পূরণ না করলে শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটি সময় বলে দেবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, ধানের শীষের পক্ষে ভোট চেয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন রাজনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক বার্তা দিলেন। ফলে জনগণও বুঝবে, বিএনপি নির্বাচন চায়, নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চায় না। ফলে সরকারকে এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ফখরুল বলেন, সরকার যদি মনে করে বিএনপি নির্বাচনে এসেই গেছে, আর আলোচনার দরকার নেই, তাহলে ভুল করবে। কারণ নির্বাচন বর্জন শেষ দিনেও করা যায়।

দলটির একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, কৌশলগত বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করেই নির্বাচনমুখী অবস্থান স্পষ্ট করেছে বিএনপি। এর প্রথম উদ্দেশ্য হলো দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখা। দ্বিতীয়ত, জনগণকে দেখানো যে বিএনপি নির্বাচনের মাঠে নেমে গেছে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত সরকার যদি কোনো দাবি না মানে এবং বিএনপির নির্বাচন বর্জন করতে হয়, সেই দায় যেন সরকারের ওপরেই বর্তায়—এমনটিই লক্ষ্য তাদের।

আগেই নির্বাচনে নেমে পড়ার ঘোষণা দিলে সহায়ক সরকারসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে বিএনপির দর-কষাকষির সুযোগ কমে যাবে বলে দলটির একাংশের অভিমত। অনেকের মতে, সহায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না—এমন বক্তব্য ওই অংশের নেতাদের মুখ থেকেই শোনা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ওই ধরনের বক্তব্য কমে গেছে।

জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়  বলেন, ‘নির্বাচনে তো বিএনপি যাবেই। কিন্তু হঠাৎ করে ধানের শীষের পক্ষে চেয়ারপারসন কেন ভোট চাইলেন সে কারণ আমার জানা নেই। ’ তা ছাড়া নির্বাচনী এলাকা কেরানীগঞ্জে ব্যস্ত থাকায় এ বিষয়টি জানা যায়নি; যোগ করেন বিএনপির এই নেতা।

১৪ জুন বসুন্ধরা কনভেনশন সিটিতে বিএনপির এক ইফতার পার্টিতে দেওয়া বক্তব্যে হঠাৎ করেই ধানের শীষের পক্ষে ভোট চেয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সরকারকে আর একতরফা নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। ’ তিনি ভোটের প্রস্তুতি নিতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। একইভাবে পরেরদিন ১৫ জুনও তিনি জানান, ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হঠাৎ চেয়ারপারসনের নির্বাচনমুখী ওই বক্তৃতা শুনে সেদিন উপস্থিত বিএনপি নেতারাও হকচকিয়ে যান। পরে তাঁদেরকে খালেদা জিয়া জানান, ইতিবাচক রাজনীতির আবহ তৈরি করার জন্যই তিনি ধানের শীষে ভোট চেয়েছেন। সেই সঙ্গে উপস্থিত নেতাদের তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আলোচনা এবং গুলশান কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক একাধিক বৈঠকের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।

জানা যায়, গত ২২ মে দলটির স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে নির্বাচনে ‘যাওয়া না যাওয়া’ প্রশ্নে নেতাদের বক্তব্য তথা দলীয় অবস্থান প্রশ্নে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ওঠে। সিনিয়র একাধিক নেতা বৈঠকে বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি নেতারা একেকজন একেক রকম বক্তব্য দিচ্ছেন। বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে এক নেতা বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কেয়ামত পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে যাবে না’—এ ধরনের বক্তৃতা আসছে। পাশাপাশি বিএনপি নির্বাচনে যাবে—এ ধরনের কথা মওদুদ আহমদসহ সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতা দিচ্ছেন। ফলে বিএনপির প্রকৃত অবস্থান নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, যা দূর করা দরকার বলে নেতারা অভিমত দেন।

সূত্রের দাবি, এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া উপস্থিত সব নেতার মতামত জানতে চান। তিনি এও বলেন, বক্তব্য সবার এক সুরে হওয়া উচিত। এরপর উপস্থিত কয়েক নেতা বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর, এমনকি মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পরও তা প্রত্যাহার করে নেওয়া যায়। তা ছাড়া নির্বাচনে যাব না—এ কথা বললে ইসি পুনর্গঠনসহ নির্বাচনমুখী যেসব তৎপরতা বিএনপি চালাচ্ছে সেগুলো নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠবে বলে কয়েকজন মতামত দেন।

নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, ওই দিনের আলোচনা ছাড়াও দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন প্রশ্নে আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় নেতারা যুক্তি দেন, সহায়ক সরকার না হলে নির্বাচনে যাব না—এ কথা না বলে সহায়ক সরকারের দাবি পূরণ করেই নির্বাচনে যাব—এভাবে বলা ঠিক হবে। তা ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বললে নেতাকর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়। আবার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে বর্তমানে বিএনপি নির্বাচনমুখী যেসব তৎপরতা চালাচ্ছে সে বিষয়ে সরকার কিংবা জনগণও প্রশ্ন তুলতে পারে বলে কেউ কেউ মত দেন।

বস্তুত বিএনপির নির্বাচনমুখী তৎপরতা শুরু হয় গত বছরের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিল থেকে। সেখানে খালেদা জিয়া ‘ভিশন ২০৩০’ শিরোনামে বিএনপির রূপকল্প উপস্থাপন করেন; যাতে ক্ষমতায় গেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দল কী কী পদক্ষেপ নেবে তা তুলে ধরা হয়। আবার ওই রূপকল্পই বিস্তারিত প্রস্তাব ও প্রতিশ্রুতি আকারে জনসম্মুখে উপস্থাপিত হয় গত ১০ মে। এর আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে গত বছরের ২০ নভেম্বর ১৩ দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করে বিএনপি। আর এখন নির্বাচনে যাওয়ার জন্য দলটি সহায়ক সরকারের প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে, যা ঈদের পরে উপস্থাপন করার কথা।

এ ছাড়া নির্বাচনী রোডম্যাপ অনুযায়ী মধ্য জুলাইয়ে অনুষ্ঠিতব্য ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বিএনপিতে। বিশেষ করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) যেসব ধারা বিএনপি সংশোধন বা পরিমার্জন চায় সেগুলো নিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব দাবি বা সুপারিশ করা হবে তারও প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। গত ১২ জুন এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে সারা দেশের তৃণমূলে চিঠি পাঠিয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চিঠিতে সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে কোন কোন আসনে ঝামেলা রয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রে পাঠাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ভোটার তালিকা থেকে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যাতে বাদ না পড়ে এবং সরকার সমর্থকরা যাতে ভুয়া ভোটার না করতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে চিঠিতে।

জানা যায়, তৃণমূল থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে ইসির হস্তক্ষেপ চাইবে বিএনপি। দলটি ইসি ঘোষিত রোডম্যাপও প্রত্যাখ্যান করেনি।

বিএনপি নেতাদের মতে, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে। আর ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচনের বিকল্প নেই। সার্বিকভাবে এসব তৎপরতা প্রমাণ করে; বিএনপি নির্বাচনে যাবে।

উৎসঃ   কালের কণ্ঠ

bhorersanglap