মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কি জিতবে?

ভোরের সংলাপ ডট কম :
জুন ১৭, ২০১৭
news-image

দিন পনেরো বাংলাদেশ ঘুরে এসেছি। যাওয়ার সময় দেখে গেছি, ব্রিটেনে ৮ জুনের নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে।

মিডিয়া ও পণ্ডিতকুলের মুখে একই কথা, টেরেসা মে বিপুল ভোটে জিতবেন। আর লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন? আরে ছোঃ ছোঃ ও আবার নেতা নাকি? কেউ তাঁকে ভোট দেবে না। করবিন নেতা থাকলে লেবার পার্টি কোনো দিন নির্বাচনে জয়ী হবে না! ধরেই নিয়েছিলাম, বিগ মিডিয়া ও এলিট ক্লাসের শিরোমণিদের এ কথাই সত্য হবে।
৩১ মে ঢাকা থেকে লন্ডনে ফিরে এসেছি। তখনো বিগ মিডিয়া ও এলিটকুল-শিরোমণিরা টেরেসা মের প্রশংসা ও করবিনের নিন্দায় মুখর। জনমত সমীক্ষায় টোরি ও লেবার দলের জনপ্রিয়তায় গ্যাপ তখন কমছিল, টাইমস, টেলিগ্রাফ, সান, ডেইলি মেইল জোটবদ্ধ হয়ে ভোটারদের আবেদন জানাচ্ছে, টোরিদের ভোট দাও। করবিন ক্ষমতায় এলে ব্রিটেনের সর্বনাশ হয়ে যাবে। বর্তমান বিশ্বে মিডিয়া এত শক্তিশালী যে ভেবেছি, মিডিয়া ও এস্টাবলিশমেন্টের প্রচারণার ঝড়ে লেবার পার্টি নির্বাচনে তাসের ঘরের মতো উড়ে যাবে।

 

৮ জুন ভালোয় ভালোয় নির্বাচন হয়ে গেল। শুক্রবার ৯ জুন ঘুম থেকে উঠে শুনি নির্বাচনে হ্যাং পার্লামেন্ট হয়েছে। টোরি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে এককভাবে সরকার গঠনের ক্ষমতা পায়নি। অভূতপূর্ব বিজয় হয়েছে জেরেমি করবিন ও তাঁর লেবার পার্টির। টোরি শাসনে ত্যক্তবিরক্ত যুব সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে করবিনকে ভোট দিয়েছে। এই নির্বাচনে বিরাট নৈতিক জয় হয়েছে ওল্ড লেবার পার্টির নীতি ও আদর্শের। দলের ভেতরে ব্লেয়ারপন্থী বিভীষণের দলও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই নির্বাচনের ফলে শুধু ব্রিটেনের রাজনীতি নয়, বিশ্বরাজনীতির ধারা বদলাতে চলেছে। আগ্রাসী গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের জন্য এটি একটি দুঃসংবাদ। তাদের প্রচারণা ব্যর্থ।

ব্রিটেনের এই সাধারণ নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে আসি নিজের দেশের নির্বাচনের কথায়। শেখ হাসিনার সরকার শত বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে এখনো ক্ষমতায় আসীন। কিন্তু একটি সাধারণ নির্বাচন দ্রুত এগিয়ে আসছে। দেশে এখন নানা বিতর্ক। ভাস্কর্য অপসারণ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে কথিত মনোমালিন্য ইত্যাদি। সুলতানা কামালের বক্তব্য নিয়ে হেফাজতি হুঙ্কার এই বিতর্ককে আরো একটি নতুন ডাইমেনশন দান করেছে। সবার ওপরে আগামী নির্বাচন নিয়ে জল্পনা-কল্পনাই বেশি সরব। বিএনপি মুখে বলছে, তারা হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রবল তোড়জোড় ও প্রস্তুতি চলছে এই দলের। খালেদা জিয়া তাঁর ভাঙা শরীর নিয়েও নড়েচড়ে বসেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও বসে নেই। ক্ষমতায় দীর্ঘকাল থাকার আলস্য ত্যাগ করে তারাও ঘর গোছানোর কাজে লেগেছে। ১৫ দিন দেশে থাকার সময় বুঝেছি, ধীরে হলেও নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

কিন্তু এই হাওয়ায় যে কানাঘুষা ও জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে, তা প্রায় নির্বাচনপূর্ব ব্রিটেনের মতো। অনেকেই বলছেন, দেশের এত উন্নয়ন করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ভোট পাবে না। ঠিক ব্রিটেনের নির্বাচনের আগে বিগ মিডিয়া ও এলিট ক্লাসের শিরোমণিরা যেমন রব তুলেছিলেন, লেবার পার্টি ভোট পাবে না; তেমনি এবার ঢাকায় গিয়ে শুনলাম, নাগরিকসমাজ ও সুধীসমাজের একটা বড় অংশের মুখে, আওয়ামী লীগ সরকার যত ভালো কাজই করে থাকুক, তাদের একশ্রেণির মন্ত্রী ও এমপির দুর্নীতির জন্য তারা ভোট পাবে না।

এই কানাঘুষা বা হুইসপারিং ক্যাম্পেইনটি এত প্রচ্ছন্নভাবে চালানো হচ্ছে যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী—যেখানেই যত সুধীজনের আড্ডায় বসেছি, এই কানাঘুষাটি শুনেছি। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক হিতৈষীর মুখেও শুনেছি, ‘এবার ফেয়ার নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জিতবে না। ’ আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করেছি, ফেয়ার নির্বাচন বলতে তাঁরা কী বোঝেন? আওয়ামী লীগ এযাবৎ যথাসম্ভব নিরপেক্ষ নির্বাচন করেনি, তার কোনো প্রমাণ আছে কি? প্রকাশ্যে ও নির্লজ্জভাবে নির্বাচন-কারচুপির প্রমাণ তো রয়েছে বিএনপির বিরুদ্ধে। তাদের শাসনামলে মাগুরা উপনির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কারচুপির যে রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে, আওয়ামী লীগ তো এখনো তা ভাঙতে পারেনি। তাহলে নির্বাচনে কারচুপি সম্পর্কে বেগম জিয়ার গলা এত চড়া কেন? আমার মনে হয়, ‘চোরের মায়ের গলা বড়’ এই প্রবাদটি এখানে সত্য।

দেশে পনেরো দিন অবস্থান করেই বুঝতে পেরেছি, নির্বাচনের বেশ আগেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে প্রচারণার জাল বিস্তার শুরু হয়েছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষিত হওয়ার আগেই সূক্ষ্ম প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ ভোটারদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে যে আওয়ামী লীগ ভোট পাবে না। প্রচারকদের হয়তো বিশ্বাস, মানুষের মনে এই ধারণাটি ছড়িয়ে দেওয়া গেলে তারা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে উৎসাহী হবে না এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সত্যি সত্যিই হেরে যাবে। ঠিক এই কৌশলটিই ব্রিটেনের নির্বাচনে গ্রহণ করেছিল গণবিরোধী বিগ বিজনেস, বিগ মিডিয়া ও এস্টাবলিশমেন্টের সম্মিলিত চক্র। করবিন চরম বামপন্থী, নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য নেতা, তিনি ইহুদি রাষ্ট্রের বিরোধী, ফিলিস্তিনিদের সমর্থক (তিনি আইআরএ-রও সমর্থক ছিলেন) ইত্যাদি প্রচারণা চালিয়ে তিনি লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাঁর নেতৃত্ব ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে। এবারের নির্বাচনে সেই প্রচারণা শত গুণ বাড়ানো হয়েছিল। ভোটদাতাদের এ কথাই বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল যে করবিনকে ভোট দিয়ে লাভ নেই। লেবার দলের নির্বাচনে জেতার কোনো আশা নেই।

বাংলাদেশের হাসিনা-নেতৃত্ব ও ব্রিটেনের করবিন-নেতৃত্বের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হাসিনা যখন প্রথম আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন, তখন একই মহল থেকে একই কথা ছড়ানো হয়েছিল যে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতায় যাবে না। হাসিনা-নেতৃত্ব ধ্বংস করার জন্য শুধু গুজব ছড়ানো নয়, তাঁর চরিত্র হনন নয়, তাঁর জীবননাশেরও চেষ্টা হয়েছিল। করবিনেরও শুধু প্রাণনাশের চেষ্টা ছাড়া আর কোনো চক্রান্ত নেই, যা তাঁর বিরুদ্ধে করা হয়নি। কিন্তু করবিন ব্রিটেনের তরুণ প্রজন্মের ভোটদাতাদের সামনে নতুন ভবিষ্যতের আশা তুলে ধরে গণবিরোধী জোটের সব প্রচারণা ব্যর্থ করে দিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতির মোড় আবার প্রগতিশীলতার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। প্রতিক্রিয়াশীলদের দুর্গে ভাঙন ধরিয়েছেন।

বাংলাদেশেও আগামী নির্বাচনের আগে যে মহলটি নেপথ্যে বসে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতবে না বলে সূক্ষ্ম প্রচারণা চালাচ্ছে, তাদের স্বরূপ চিনতে আমার দেরি হয়নি। এখানেও এস্টাবলিশমেন্টের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ, তাদের সহযোগী এলিট ক্লাস ও একটি মিডিয়া চক্র এখন প্রচ্ছন্নভাবে এই প্রচারণাটি চালাচ্ছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষিত হলে তারা যে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসবে তাতে আমার সন্দেহ নেই। তবে তাদের এই সম্মিলিত প্রচারণা ও চক্রান্ত এবার ২০০১ সালের মতো সফল হবে কি না সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে।

ব্রিটেনের মতো বাংলাদেশেও একটি বিগ মিডিয়া গ্রুপের ভূমিকা এখন সাধারণ মানুষের কাছে উন্মোচিত। তাদের বিষদাঁত ভেঙে গেছে। সুধীসমাজের চক্রান্তকারী অংশটিও চিহ্নিত। তারা গুজব ছড়াতে পারবে ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে হুইসপারিং ক্যাম্পেইনও চালাতে পারবে। তবে তাতে সফল হবেন কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ভুলত্রুটি আছে, ব্যর্থতা আছে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি তরুণসমাজের সামনে ডিজিটাল দেশ গড়ার স্বপ্ন তুলে ধরেছে, সেই স্বপ্নের মশাল এখনো নেভেনি। আওয়ামী লীগ তার ভুলত্রুটি সংশোধন করে তরুণ প্রজন্মের সামনে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারলে আগামী নির্বাচনে তার জয়ী না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্রিটেনের মতো বাংলাদেশের নির্বাচনও গণশত্রুদের ছড়ানো গুজব ও প্রচারণা ব্যর্থ করে দিয়ে হাসিনা-নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ের মালা ছিনিয়ে আনতে পারবে এ সম্ভাবনাই বেশি।

একদিকে বিএনপি বলছে, তারা শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচনে যাবে না; অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলছেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০টির বেশি আসন পাবে না। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বাজারি গুজবেরই এটা কি প্রতিধ্বনি নয়? তাতেই আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বাজারে যে কথাগুলো শোনা যাচ্ছে অথবা ছড়ানো হচ্ছে তার অন্তত একটি উৎসমূল কোথায়, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। নির্বাচনের দিনক্ষণই এখনো ঘোষিত হয়নি। তার আগেই মির্জা ফখরুল কী করে জেনে গেলেন আওয়ামী লীগ মাত্র ৩০টি আসন পাবে?

আওয়ামী লীগ সম্পর্কে এ ধরনের কথা বিএনপি নেত্রী আগে নিজ মুখে বলতেন। এক নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ আগামী ৫০ বছরেও ক্ষমতায় যেতে পারবে না। ’ তারপর আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতায় যাওয়া নয়, দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দেশকে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে এগিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি সংসদ ও রাস্তার রাজনীতি থেকেও বিতাড়িত এবং নিঃসঙ্গ অস্তাচলযাত্রার পথিক।

আওয়ামী লীগের দোষত্রুটি নেই, তা নয়। দোষত্রুটি, ব্যর্থতা সবই তার আছে। সেই সঙ্গে আছে একশ্রেণির এমপি, মন্ত্রী, উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় নেতার ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি। কিন্তু বিএনপি আমলের দুর্নীতি ও অপশাসনকে কি তা ছাড়িয়ে গেছে? বিএনপি ও জামায়াত দুর্নীতি, অপশাসন ও সন্ত্রাস সম্পর্কে জোর গলায় কথা বলে কিভাবে? দেশের মানুষের স্মৃতিশক্তি কি এতই দুর্বল?

আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়ন দিয়েছে, সুশাসন এখনো দিতে পারেনি। এই সুশাসন দেওয়ার জন্য দল ও সরকার দুইয়েরই সংশোধন ও পুনর্গঠন দরকার। এ জন্য প্রয়োজন দলের ভেতরে জোরালো সংস্কার আন্দোলন। সব পরগাছা ঝেঁটিয়ে সাফ করতে হবে। তরুণ ভোটদাতাদের সামনে আশার আলো তুলে ধরতে হবে। করবিনের নির্বাচনী ইশতেহারের মতো শেখ হাসিনার এবারের নির্বাচনী ইশতেহার যেন হয় স্বচ্ছ ও বাস্তবতার আলোকে রচিত।

‘গুজবে কান দিতে নেই’ কথাটা সর্বাংশে সঠিক নয়। আগামী নির্বাচনসংক্রান্ত গুজবে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই কান দিতে হবে এবং জনগণের মন থেকে তার প্রভাব দূর করতে হবে। আমার বিশ্বাস, এখন থেকে আওয়ামী লীগ সতর্ক ও সক্রিয় হলে আগামী নির্বাচনে তার জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।

লেখক ও সাংবাদিক :  আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

 

bhorersanglap

আরও পড়তে পারেন