পাপ-পূণ্যের শূন্য ফলাফল
কারো কারো রক্তে বিষ থাকে কিংবা গায়ে থাকে বিষের রক্ত। তা না হলে আক্কাস আলীর জীবনটা এমন হবে কেন! আক্কাস আলী নামটা বড় পুরনো। অন্তত এ যুগের ছেলে বলে নামটার প্রতি তার ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে ক্ষোভ আদৌ রয়েছে কি না তার খবর নেওয়া খুব জরুরি নয় হয়তো! কপাল নিয়ে জন্মে আর ক’জন, কিন্তু আক্কাস আলীর জন্মটা বড় ভালো। বাবা এমাজউদ্দিন একটা ব্যাংকে ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন।
মা দিলারা বেগম ছিলেন এক ধনী বৃদ্ধের একমাত্র কন্যা। আর তাই ঘরজামাই হিসেবেই থাকতে হতো এমাজউদ্দিনকে। তাতে অবশ্য ক্যাশিয়ারের কোনো আপত্তি ছিল না, বরং আরামের জীবন বেশ পছন্দই ছিল তার। বৃদ্ধ মৃত্যুর আগে অনেকেরই হক মেরে সবকিছু মেয়ের নামে দিয়ে গিয়েছিলেন। দিলারা বেগমের চরিত্রের দোষ। অনেকেই টের পায়। স্বামী ব্যাংকে গেলে অন্য পুরুষ এসে বাড়িতে ঢোকে। আবার কখনো তাকেও পরপুরুষের সাথে মাঝে মাঝেই দেখা যায়। পাড়াপড়শী আড়ালে ক্যাশিয়ারের রাতের ক্ষমতা নিয়ে হাসাহাসি করে। তা হলেও এসব ব্যাপারে মানুষ মজা পায় বেশ।
দৈনন্দিন নিরামিষ জীবনে একটু-আধটু আমিষের মত যেন। বেরসিকের মত কেউ আবার ক্যাশিয়ারের কানে কথাটা তুলে দিয়ে আসে। হয়তো সবার জন্য দিলারা বেগমের দ্বার উন্মুক্ত ছিল না কিংবা প্রস্তাব দিয়ে মুখ চুন করে ফিরে আসা লোল কোন পুরুষ, যার হৃদয় পক্ষাঘাতগ্রস্ততার পেছনে দিলারা বেগমের হৃষ্টপুষ্ট স্তনগুলো দায়ী।
আক্কাস যখন প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হল; ততদিনে তার আরো এক ভাই এক বোন জন্মে গেছে। যেদিন হাতেনাতে ধরা পড়ে দিলারা বেগম, সেদিন ক্যাশিয়ারের ব্যবহার ছিল অদ্ভুত। দিলারা বেগম হয়তো চড়চাপ্পড় আশা করেছিল, এমন নীরব শাস্তির কথা চিন্তাও করেনি। ঘন ঘন সে এ বিষয়ে আলটিমেটাম পেয়েছে এমন নয় কিন্তু ক্যাশিয়ার তালাক দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ততদিনে। সংসার যখন ভাঙে বড় বিচিত্র তার প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে মূল মানুষগুলোকে কেন্দ্র করে যে ছানাপোনারা বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত, তাদের মত অসহায় জীব বুঝি তখন আর কিছু থাকে না।
সন্তানদের বিপদে ফেলতে চাননি এমাজউদ্দিন। তাই তিন সন্তানকে নিয়ে তিনি চেষ্টা তদবির করে বদলি হয়ে যান খুব অল্প সময়েই। কিন্তু অভিভাবকহীন দিলারা বেগম বোধহয় এত কিছু আশা করেননি। এক লহমায় কৃতকর্মের এমন ফলাফলে তিনি বেশ ধাক্কা খান। তখন তিনি সন্তানদের জন্য মরিয়া হয়ে আদালতে মামলা-মোকাদ্দমা করতেও প্রস্তুত। ছায়াবিহীন নারীর জন্য প্রত্যেক পুরুষই হয়তো বর্ষাতির কাজ করাকে দ্বায়িত্ব মনে করে। তেমনই পরামর্শদাতার অভাবও কোন কালে ছিল না। বিশেষত যার পয়সা আছে কিন্তু মাথার উপর অভিভাবক নেই।
দিলারা বেগমের বাড়িতে তখন উকিল-মুহুরির ঘন ঘন আনাগোনা। ততদিনে দিলারার আগের প্রেমিক হাওয়া; এক দোকানের কর্মচারী ছিলেন তিনি। এখন এসব ঘটনার পর মালিক পক্ষ তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল বলে না কি দিলারা বেগম বিমুখ হওয়ার কারণে তিনি মনের দুঃখে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। মোটকথা তিনি এরপরের কোনো ঘটনায় আর ছিলেন না।
মামলা-মুকাদ্দমার কারণে আর কিছু না হোক একটা লাভ হল মুহুরির আর তা হল দিলারা বেগমের খুব কাছাকাছি আসার সুযোগ পেলেন তিনি। অবশেষে আপাত নিঃসঙ্গতা দূর করে দিলারা বেগম বিয়ে করলেন সেই মুহুরিকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মাঝে মাঝেই সাদা কাগজে সই করিয়ে মুহুরি একসময় দিলারা বেগমের বেশির ভাগ সম্পত্তি হাতিয়ে নিলেন।
বাবা আবার বিয়ে করলে আক্কাস আলি পালিয়ে এসেছিল মায়ের কাছে। অথচ যখন মা বিয়ে করল, তার আর পালানোর কোনো জায়গা রইল না। সেই থেকে আক্কাস আলীর পরিবর্তন শুরু।
ভেতরে শৈশব পেরুনোর ডাক, ফুটন্ত ভিসুভিয়াস। মানুষের উপর অক্ষম রাগ, প্রতিটি মানুষ তখন তার নিশানা। দিলারা বেগমের মুহুরি স্বামী মোটেই ভালো চোখে দেখেন না আক্কাসকে। ছেলেটার কেমন যেন খুনে চোখ, সদ্য গোঁফ ওঠায় যে জড়তা আক্কাস আলীর ভেতরে থাকার কথা, ভাঙা স্বরের মধ্যে তা তো নেই বরং প্রচণ্ড জেদ আর অন্যরকম আত্মবিশ্বাস খেলা করে।
এই বয়সেই বন্ধুরা খুব বেশি কাছের মানুষ হয়ে যায়। কারো মধ্যে যদি আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে তবে তো কথায় নেই। শুকুরসহ বেশকিছু বন্ধু তখন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। পড়ালেখা তখন আর আক্কাসের ভালো লাগে না। নৃশংসতা ভালো লাগে। মুরগীর গলা দু’হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলে আক্রোশ নিয়ে। এরকম সময়ে তার চোখদু’টো ভয়াবহ নেশায় আসক্ত মানুষের মত চকচক করে। কারো বাগানের ফল পাড়া কিংবা কারো খোয়াড়ের হাঁস-মুরগী ধরার মত কাজ সে কখনো করেনি। তবে তার বন্ধুরা করতো। আক্কাসের হাতে প্রথম রক্ত ঝরে মানুষের, এক বনভোজনে।
বেচারা ছেলেটি মাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চাল, ডাল, ডিম সাথে পিকনিক করতে গিয়েছিল অতি আগ্রহ নিয়ে। খুব বেশি বয়স ছিল না ছেলেটির। শাবল দিয়ে চুলার জন্য মাটি খুঁড়ছিল শুকুর আর বাচ্চা ছেলেটিকে দেয়া হয়েছিল মাটি সরানোর কাজ। তখন যদি কেউ আক্কাসের চোখের দিকে দেখত নিশ্চয়ই তার চকচকে নেশাময় চোখ
দেখতো। কেউ দেখেনি আক্কাস ভেতরে ভেতরে কেমন ছটফট করছে অক্ষম রাগে। কতটা মানসিক যন্ত্রণায় তার ভেতরটা অমন নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর হচ্ছে।
মায়ের চরিত্রের কথা যখন কেউ মুখের উপর শুনিয়েছে, আক্কাস আলীর ভেতর তখন কি আক্রোশ পুড়েছে! তা একমাত্র ভগবানই জানেন! শুকুরের হাত থেকে শাবল নিয়ে ধীর মাথায় কোপ বসায় আক্কাস। গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারে বা এটি কোনো গল্পই নয়। গল্পের চেয়েও জটিল বাস্তব জীবন। কিন্তু এটাই সত্যি যে, আক্কাস ছেলেটি অন্যদের চেয়ে আলাদা কিংবা পরিবেশের চাপ তাকে অন্যরকম করে দিয়েছে। মানসিকভাবে অসুস্থ একটা রোগীর মত। ছেলেটি তার কাটা হাত নিয়ে সারাজীবন বহন করবে আক্কাসের নিষ্ঠুরতা।
সে রাতে মহল্লার মানুষ আক্কাসের জান্তব চিৎকার শোনে। হয়ত আক্কাস সেদিন বেশি অস্থির ছিল বলে মুহুরি বাপের চোখে চোখ রাঙিয়ে কথা বলছিল অথবা খাবারের থালা ছুঁড়ে মায়ের উপর পুষে রাখা রাগ কিছুটা প্রকাশ করেছিল। ঘটনা যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, আক্কাস সেদিন চিৎকার করেছিল এক কি দু’বারই। তারপরের দিন থেকে এই অন্যরকম ছেলেটিকে আর মহল্লায় দেখা যায়নি। বিভিন্নজন অনুমানের উপর তাদের মতামত ঠিকই প্রকাশ করেছিল বিকেলের প্রাত্যহিক জটলায়। অজানার প্রতি আজন্ম কৌতুহল বলে সব কৌতুহলের পরিণাম যে সুখকর তা হয়ত নয়। কৌতুহলের বশেই মানুষ সৃষ্টিশীল, ধ্বংসেও তেমনি।
বহুদিন পর যখন দিলারা বেগম বাস্তবিকই পাগল হয়ে যান; তখন তার প্রলাপের সাথে অনেক অজানা ঘটনার গুপ্ত তথ্য বেরিয়ে আসতো। তিনি হয়ত পোস্টমর্টেম করেন ঘটনার। কি হয়েছে আর কি হতে পারতো। আক্কাস আলীর পরদিন নিখোঁজ হওয়ার ধোঁয়াটে দিকটা প্রকাশিত হয় এভাবেই। মুহুরি তাকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেনি কিন্তু খুঁটির সাথে বেঁধে গরম খুন্তির যে কটি ছ্যাঁকা দিয়েছিলেন তার প্রথম দু’একটির জন্য আক্কাসের ছিল অমন জান্তব চিৎকার। শোনা যায়, পরদিন আক্কাস বাড়ির সাইকেলটা নিয়ে পালায়।
সাইকেল বিক্রি করে আক্কাস কিছু টাকা পেতে পারতো, কিন্তু সে চিরকালের মত হারিয়েছিল আশ্রয়। অনেক বছর পরে যদি পাপ-পূণ্যের হিসেব কষে আক্কাস, তখন তার যে পাল্লাটাই ভারি হোক না কেন সময় কিন্তু থেমে ছিল না। বস্তায় ভরা কুঁজোবুড়ির মত সময় গড়ায়। দিলারা বেগমের পূর্বপুরুষ কিংবা আক্কাস আলীর পরবর্তী প্রজন্ম কাহিনির পর কাহিনি জন্ম দিয়েছিল এবং দিতে থাকবে। পক্ষপাতহীন মহাকাল ফলাফলের শূন্যতায় ডুবে আছে তবু চলমান তার গতি।
আশ্রয় ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে আক্কাস পথে বেরিয়েছিল। জীবনযুদ্ধে আশ্রয় কি জরুরি তা হয়তো আক্কাসরাই ভালো বোঝে। দিনমান আক্কাস সাইকেল চালিয়ে বহুদূর যায়, এভাবেই আরো দূর। কখন সে সীমানা ছাড়িয়ে গেছে…