সোমবার, ২২শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আকরম খাঁ : তার সাহিত্য ও সাংবাদিকতা

ভোরের সংলাপ ডট কম :
আগস্ট ২৫, ২০১৭
news-image

জাতীয় রেনেসাঁর অগ্রপথিক, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সিংহপুরুষ এবং গণমাধ্যমের গুরু মওলানা আকরম খাঁ। উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ, স্বৈরাচার এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন এক কর্মী। জুলুমবাজ জমিদারদের জনবিরোধী জঘন্য নীতি, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, স্বেচ্ছাচারিতা, অনাচার, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তার সবাক অবস্থান সুস্পষ্ট। মানুষ ও মানবতার জয়গানে মুখরিত ছিল তার গোটা জিন্দেগি।

এ সমাজে মিথ রয়েছে ইংরেজি বিদ্যা ছাড়া জীবনে কৃতকার্য হওয়া যায় না। আকরম খাঁ সেই মিথ বা বিশ^াস গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, শূন্য রিক্ত হস্ত দিয়ে দেশ-জাতির কল্যাণে অনেক কিছু করা সম্ভব তারও দৃষ্টান্ত মওলানা। তিনি মিডিয়া মহলের মহানায়ক হয়ে রইলেন। পত্রিকা প্রকাশ, সরকারি রোষানলে বন্ধ, আবার নতুন পত্রিকার জন্ম, বারবার কারাবরণ, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এতকিছুর পরও তার লেখনীকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। রাজনীতির শত বছরের ভাঙা-গড়ায় তিনিই বিজয়ী বীরসেনানী। মেধা, অধ্যবসায়, জ্ঞানচর্চা ও চিন্তাশীলতার শক্তির জোরে সব প্রতিবন্ধকতাকে প্রতিহত করে অর্জন করেছেন সফলতাকে। তিনি কখনো রাজক্ষমতায় বসেননি। কিন্তু ক্ষমতাবানরা তার কাছে ছিল অধীনস্থ কর্মচারীদের মতো।

আহলে হাদিস পত্রিকা ও আখবারে মোহাম্মদী কাগজের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। ১৯০৩ সালে মাসিক মোহাম্মদী, ১৯১০ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও দৈনিক খাদেম প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর ১৯২১ সালে উর্দু দৈনিক জামানা ও বাংলা দৈনিক সেবক, ১৯২২ সালে দৈনিক মোহাম্মদী। বাংলার মানুষকে জাগানোর জন্য ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদ। দৈনিক আজাদের জন্মলাভ না হলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো কিনা তা গবেষণার বিষয়।

বুদ্ধিদীপ্ত প্রবন্ধ নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, কলাম, রচনাসম্ভার তার মনীষা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার মুন্সিয়ানার প্রামাণ্য দলিল। বর্তমানে সাহিত্য-সাংবাদিকতায় যারা পরিচিত মুখ সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আকরম খাঁর সৃষ্টি। তার সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য ছিল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে পথ দেখানো, আত্মসচেতন করে তোলা, শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর করা, বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধন, লেখক-সাংবাদিক তৈরি, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা, আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে উন্নীত করা, স্বজাতির মুক্তি।
সাহিত্যব্যক্তিত্ব ও দৈনিক দিনকালের সাবেক সম্পাদক মরহুম সানাউল্লাহ নূরী লিখেছেন, ‘অনিবার্য পতনের এই প্রাকমুহূর্তে বিশ^াসের একটি ধ্রুব নক্ষত্রের মতো মওলানা আকরম খাঁর আবির্ভাব। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মানসিক অবসাদের অচলায়তন ভাঙতে না পারলে কিছুতেই মুক্তি সম্ভব নয়। তীব্র শ্লেষে সুতীক্ষè খোঁচায় ক্ষয়িত সমাজের মর্মমূল বিদ্ধ করার প্রয়োজন তিনি বোধ করলেন। মাসিক মোহাম্মদী তার এ বিশ^াস এবং সঙ্কল্পেরই বাঙময় প্রকাশ। সুদীর্ঘ আটান্ন বছর ধরে এ সাময়িক পত্রটি জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করেছে, অন্ধতা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করার আবেগকে ভাষা দিয়েছে। আজকের তরুণদের কাছে অতীতের এ অধ্যায় হয়তো অনুদঘাটিত। পেছনে যে ইতিহাস আমরা ফেলে রেখে এসেছি তার ওপর দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যাবে এই একটি মানুষ কতখানি শক্তি নিয়ে দুর্যোগের অগ্নিসেতু পাড়ি দিয়ে এসেছেন। চলার পথের বাঁকে বাঁকে ছিল জমাট অন্ধকার। তিনি দৃঢ়পায়ে সামনে এগিয়েছেন আর সেই অন্ধকারে একটি একটি করে দ্বীপ জ্বেলেছেন।

আমাদের সাংবাদিকতার অগ্রপথিক যদি কাউকে বলতে হয় তবে নিঃসন্দেহে তিনি মওলানা আকরম খাঁ। সাংবাদিকতার জন্য এত দুঃখ বরণ, সংবাদপত্রের কণ্ঠকে অকম্পিত রাখার জন্য এমন একাগ্র সাধনা আর এমন নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের দৃষ্টান্ত বিরল।’

মওলানার অতি উঁচুমাপের গদ্যসাহিত্যের আকর্ষণে তার চতুর্পাশে ভিড় জমায় দেশের সাহিত্যরসিকরা। চিন্তার খোরাক জোগায় চিন্তাবিদদের। আঠারো-উনিশ শতকজুড়ে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক যে দৈন্য ছিল আকরম খাঁর প্রভাবে তা দূরীভূত হয়। সৃষ্টি হয় একদল সৃজনশীল চিন্তানায়ক, সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ যাদের অবদানে আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক।

মওলানা আকরম খাঁর কালজয়ী সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে, কোরআন শরীফ (১৯০৫), যীশু কি নিষ্পাপ (১৯১৫), এসলাম মিশন (১৯১৭), আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার রিপোর্ট (১৯১৮) মোস্তফা-চরিত (১৯২৫), উম্মুল কেতাব (১৯২৯), সমস্যা ও সমাধান (১৯৩১), বারোয়ারী (উপন্যাস, যৌথ, ১৯৩১), পাকিস্তান নামা বা নয়া রাহে নাজাৎ (কবিতা, ১৯৪৩), তাফসীরুল কুরআন (১৯৫৯-৬০), বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম (১৯৬২), মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস (১৯৬৫)। এ ছাড়া রয়েছে ফার্সি গুলিস্তাঁর বঙ্গানুবাদ, মুক্তি ও ইসলাম প্রভৃতি।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবুল ফজল বলেছেন, ‘আকরম খাঁর উচ্চসাহিত্যিক মান ও সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে, জীবনের প্রতি স্তরে ঘটেছে বিবর্তন। দেশ ও দশের পরিবেশ ওলট-পালট হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বা মওলানা আকরম খাঁর সাহিত্যিকমানের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি, হয়নি বিন্দুমাত্র অবনমিত। রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ধ্যান-ধারণায় আমি বিপক্ষ শিবিরের লোক। তবুও আকরম খাঁর বিশুদ্ধ ও নির্বাচিত শব্দ সমন্বয়ে গঠিত সুসংঘবদ্ধ ভাষা ও তার সুগভীর ভাব পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই আমি তাঁর রচনার একজন পরম ভক্ত। ক্লাসিক রচনার স্পর্শে আকরম খাঁর ভাষা সুসমৃদ্ধ।’
প্রায় সাত দশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য, সাংবাদিকতা, রাজনীতি আর পাণ্ডিত্যের জগৎকে সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত করে রেখেছিলেন আকরম খাঁ। সমকালীন ইতিহাসে তার মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ও মহান সংস্কারক দ্বিতীয়জন আর কেউ নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমরা মওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে সকলেই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার ছিল না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ৩১) আকরম খাঁ বা দৈনিক আজাদের পয়দা না হলে হয়তো সাংবাদিকতার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

bhorersanglap