কৃষিভিত্তিক শিল্প উদ্যোগ
কৃষি খাতে আমাদের অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছে। যেমন ফাও -এর ২০১৫ সালের তথ্য মতে, বিশ্বে খাদ্যশস্য উৎপাদনে দশম, শাকসবজির উৎপাদনে তৃতীয়, বিভিন্ন ফলের উৎপাদনে ২৮তম, মাছ উৎপাদনে মিঠাপানিতে চতুর্থ আর সমুদ্রে ২৫তম। পশু উৎপাদনের সংখ্যা প্রায় চার কোটি। ফলে ভারত এপ্রিল ২০১৫ থেকে গরু দেয়া বন্ধ করার পরও দেশে পশু ঘাটতি তেমন নেই। উন্নত জাতের হাঁস-মুরগির চাষও বৃদ্ধি পেয়েছে কল্পনাতীত। ফলে ডিমের দৈনিক উৎপাদন সোয়া দুই কোটি পিস । দুধের উৎপাদনও বেড়েছে অনেক। চামড়ার উৎপাদন বর্তমানে বার্ষিক ২৪ কোটি বর্গফুটের অধিক। অর্থাৎ দেশ কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ম্ভর হয়েছে। বিশেষ করে চাল। কিছু রফতানিও হচ্ছে। দেশ-বিদেশে পাটজাত পণ্য ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে সুদিন ফিরে আসছে। অর্থাৎ কৃষি খাতই শুধু টেকসই উন্নতির পথে রয়েছে। আর দেশটি কৃষিভিত্তিকও। তবুও কৃষি খাতকে অবহেলায় রেখে শিল্পের দিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তার ফলাফল শুভ হয়নি। তাই এখন দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি হচ্ছে শুধু কৃষি, গার্মেন্ট ও প্রবাসী আয়। শেষের দু’টির অবস্থাও নিম্নগামী। সহজে ঊর্ধ্বগামী হবে না। তাই সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণে অনুমেয়- দেশের টেকসই উন্নতি, সার্বিক উন্নতি, বেকারত্ব হ্রাস, মানুষের শহরমুখী হওয়া বন্ধ, রফতানি বহুমুখীকরণ ইত্যাদির জন্য কৃষির উন্নতি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। ব্র্যাক ও ডিএফএআইডির যৌথভাবে গবেষণা রিপোর্টেও বলা হয়েছে, ‘কৃষি খাতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে দেশে দারিদ্র্য কমে শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর অকৃষি খাতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে দারিদ্র্য কমে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ।’ স্মরণীয় যে, কৃষির ব্যাপক উন্নতি হলেও শুধু ধান-চাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হওয়ার পথে। আর খাদ্যের অন্য পণ্যের উৎপাদন চাহিদার অনেক কমই রয়েছে। যেমন- সব মসলা, মাছ, গোশত, ডিম, দুধ ইত্যাদি। যা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণিত প্রতিবেদন মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ এসবে ঘাটতি হবে ১৫-২০ শতাংশ। তাই সুষম খাদ্যের যা প্রয়োজন, তার প্রতিটিই উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হওয়ার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে পুষ্টিগুণ অনুসারে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। দেশীয় ফলের পুষ্টিগুণ বিদেশী দামি ফলের চেয়ে অনেক বেশি। এটা এবং শস্যদানা, মাছ, গোশত ইত্যাদির মধ্যে কোনটির পুষ্টিগুণ সর্বাধিক- এ ব্যাপারে সরকারিভাবে সার্বক্ষণিক প্রচার করা দরকার। তাহলে মানুষ সচেতন হয়ে ব্যবহার করবে। পুষ্টিহীনতা দূর হবে। অপর দিকে, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই দেশে। তাই ফসলের ভরা মওসুমে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। অনেকে পেশা ত্যাগ করছেন, যা ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর।
দ্বিতীয়ত, কৃষিপণ্য সংরক্ষণের অভাবে বিরাট অংশ নষ্টও হচ্ছে। তাই প্রয়োজনীয় ধান-চালের গুদাম, ফলমূল প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা, শাকসবজির সংরক্ষণাগার, মাছের হিমাগার, আলু পাউডার করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নির্মাণ করা দরকার। তাহলে কোনো কৃষিপণ্যই নষ্ট হবে না। সারা বছর ব্যবহার করা যাবে। রফতানি বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া ফসল ওঠার সাথে সাথে তা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করা, সারা দেশে সমন্বিত খামার তৈরি এবং পশু ও হাঁস-মুরগি পালন আরো বৃদ্ধি করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, বিশ্বের প্রখ্যাত ফুড কোম্পানি ম্যাগডোনাল্ড ভারতের কৃষি খাতে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তারা সরাসরি কৃষককে ঋণ দিয়ে ফসল ফলিয়ে তাদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করে বাজারজাত করছে। এতে কৃষক ও ভোক্তা সবাই উপকৃত হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগী ও ভেজাল দূর হয়েছে। এরূপ ব্যবস্থা কয়েক বছর আগে পাবনায় শুরু করেছিল বিটিসি। তারা কৃষককে ঋণ দিয়ে মুখি কচুর চাষ করিয়ে তা ওঠার পর ক্রয় করে ব্রিটেনে রফতানি করত। কিন্তু এখন সে কার্যক্রম আছে কি না জানি না। না থাকলে তা পুনরায় সারা দেশেই সব ফসলের ক্ষেত্রে করার জন্য বিটিসিকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা কর্মসূচির আওতায়ও এটা করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এটা এ দেশেও চালু করা প্রয়োজন। কারণ, এসব যত বেশি হবে, ততই মঙ্গল। আরো উল্লেখ্য, কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সেচ দরকার। কিন্তু দেশের অর্ধেক নদী মরে গেছে ভারত পানি না দেয়ায়। যেটুকু নদী আছে, তারও অর্ধেক দখল হয়েছে। যেটুকু পানি আছে, তাও দূষিত হয়ে পড়েছে। অন্যসব ওয়াটার প্লেসও মজে গেছে। তাই সারফেস ওয়াটার ধরে রাখার জন্য সব ওয়াটার প্লেস সংস্কার বা পুনঃখনন করা দরকার। তাহলে বৃষ্টি ও বর্ষার পানি সংরক্ষিত থাকবে, যা সেচ ও অন্য কাজে ব্যবহৃত হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার হ্রাস পাবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হবে। উপরন্তু যেকোনো মূল্যেই হোক সব নদী দখল ও দূষণমুক্ত করা অপরিহার্য। এ ছাড়া কৃষিভিত্তিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো আবশ্যক। নতুবা ফসলের নতুন উন্নত জাত উদ্ভাবন ও ব্যাধিমুক্ত হবে না। কৃষি উপকরণের মূল্যহ্রাস ও প্রাপ্তি সহজতর, প্রয়োজনীয় ঋণ ও সুদ স্বল্প করা, কৃষি যন্ত্রপাতির সর্বাধুনিক ব্যবহার এবং তা সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে চালানো দরকার।