শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ঈদকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার

ভোরের সংলাপ ডট কম :
জুন ২৪, ২০১৭
news-image

ঈদকে আকর্ষনীয় করে গড়ে তুলতে নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত নওগাঁর ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। নতুন করে বিহারের গায়ে লাগানো হয়েছে আদি তৈরি ইট আর চুন-সুরকির কনক্রিট। এতে পুরোনো আদল ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বিহারের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি ও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করবে আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের।
আর সেই সাথে দর্শনার্থীদের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে গড়ে তোলা হয়েছে নানা অবকাঠামো। বাংলাদেশে অবস্থিত প্রত্নস্থলগুলোর মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারটি অন্যতম। এই
ঐতিহাসিক বিহারটি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এর আদি নাম সোমপুর বিহার। এ বিহারটি বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিক বিহার। হাজারো বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর বিহারটি আরো আকর্ষনীয় করে গড়ে তুলতে সংষ্কার, সংরক্ষন ও পিকনিক কর্নারসহ নানামূখী উন্নয়নমূলক কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

সংস্কারের মধ্যে রয়েছে সৌন্দর্য বর্ধনশীল ও আকর্ষনীয় মূল প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের দক্ষিন পার্শ্বের কক্ষে প্রত্নসামগ্রী ও বই রাখার ঘর। উত্তর পার্শ্বে টিকিট কাউন্টার, মহিলা এবং পুরুষ টয়লেট। নির্মান করা হয়েছে একটি মসজিদ, অফিসার্স কোয়ার্টার ব্যাটেলিয়ানদের জন্য আনসার কোয়ার্টার, স্টাফ কোয়ার্টার, ১০টি দর্শনার্থী ছাউনী। এই ছাউনীগুলোতে পিকনিকসহ দর্শনার্থীরা বসে বিশ্রাম নিতে পারবেন।
ছাউনিগুলোর পার্শ্বেই রয়েছে পুরাতন আদলে নির্মিত একটি পুকুর। এছাড়া পাথরের মনোরোম পরিবেশে নির্মান করা হয়েছে একটি বসার স্থান। রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। সাউথ এশিয়া টুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে এই কাজ বাস্তবায়ন করেছে।

এরই মধ্যে পিকনিক কর্নার থেকে সরাসরি বৌদ্ধমন্দির প্রবেশ পথে নির্মান করা হয়েছে একটি ব্রিজ। পুরাতন আদলে মন্দিরের সংস্কার কাজ করা হয়েছে। বৌদ্ধ মন্দিরের চতুর্দিকে ভিক্ষুক কক্ষ, পঞ্চবেদীসহ সকল স্ট্রাকচারের সংস্কার করা হয়েছে। সংস্কারের ফলে পাহাড়পুর শুধু দর্শনীয় এবং অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই নয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিশেষ স্থান হিসেবেও দেশে-বিদেশে ইতিমধ্যে খ্যাতি পেতে শুরু করেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষের দিকে এ বিহারটি নির্মান করেছিলেন। এ বিহারটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওযার পুর্বে পাহাড়পুর ইউনিয়নে অবস্থিত তদানীন্তন পাহাড় (গোপালের চিতা) নামে এটি পরিচিত ছিল। ১৯২৩-১৯৩৪ সালে প্রত্নতত্ত্ব খননের ফলে এই ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এরপর এ প্রত্ন স্থলে ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ (মাঝখানে ১৯৮৬-৮৭ বাদ দিয়ে) সাল পর্যন্ত একাধিক দফা খনন কাজ পরিচালিত হয়। এর ফলে স্থাপত্যিক ধংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়।

স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষটি এমনই জরাজীর্ন অবস্থায় ছিল যে সেটির বৈশিষ্ট নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ তখন কয়েকটি বিক্ষিপ্ত স্থানে কেবল একটি চওড়া দেয়ালের চিহ্নের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। তবে এ বিস্তৃত স্থাপনাটির সময় নির্ধারিত হয়েছে খ্রিষ্টাব্দ পাঁচ-ছয় শতক। তৎকালে এ এলাকাটির পরিচয় ছিল বটগোহালী। সেকালে ধ্বংসাবশেষ টিকে মঠ হিসেবে ব্যবহার করা হত।
পূর্ববর্তী জৈন বিহারটির ধ্বংসাবশেষের উপর একটি বৌদ্ধমহাবিহার নির্মিত হয়েছিল। এই মহাবিহারটির নির্মান কাজে পুর্ববর্তী ধ্বংসাবশেষটির বহু নির্মান উপকরণ পূন:ব্যবহার করা হয়েছিল। এসব উপকরণের মধ্যে কয়েকটি ভাস্কর্য উল্লেখযোগ্য। কারণ ওইসব ভাস্কর্যে খ্রিষ্টাব্দ ছয়-সাত শতকের প্রচলিত শৈল্পিকধারা বিদ্যমান ছিল। অথচ বৌদ্ধবিহারটি বরেন্দ্র ভু-খণ্ডের পালবংশীয় দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল বিক্রমশীলের (খ্রিষ্টাব্দ ৭৭১-৮১০) আমলে নির্মিত হয়েছিল।

তৎকালে এটির পরিচিতি ছিল সোমপুর বা চাঁদের লোকালয় নামে। তবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বর্তমানে যেটুকু অংশ টিকে আছে তা কেবল নিচের অংশের অংশবিশেষ মাত্র। এ অংশের উপরের দেওয়াল ও ছাদ বিহারটি আবিস্কারের বহু পূর্বেই ধ্বংস হয়ে গেছে। মূল পরিকল্পনা অনুয়ায়ী মাঝখানে একটি ছাদবিহীন চতুর ঘিরে চার বাহুতে একসারি করে ভিক্ষুক কোঠার সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছিল এই বিহারটি। এতে মোট ১১৭টি ঘর ছিল। এতে ভিক্ষুকরা বসবাস করতো।

চত্বরের মাঝখানে একটি প্রধান মন্দির ছিল। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট, প্রস্থ প্রায় ৩৫০ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট। কালের পরিক্রমায় মন্দিরের সবচেয়ে উপরের অংশ ধ্বসে গেছে। বিহারের মূল বেষ্টনির মধ্যে রয়েছে আরেকটি মন্দির। এটি মুল মন্দিরের ধংসস্তুপ বলে ধারণা করা হয়।

বিহারের উত্তর বাহুর মাঝমাঝি ছিল বাহিরের দিকে প্রসৃত গাড়ি বারান্দা আকারের সদর তোরণ। এ অংশে মুল প্রবেশ নির্গমন গলির দুই প্রান্তে থামযুক্ত দুটি হল ঘর এবং দু’পাশে একাধিক প্রহরি কোঠা ছিল। এর পূর্বদিকে উত্তর কোনের কাছাকাছি একটি অপ্রশস্ত সাধারণ প্রবেশ নির্গমন গলি এবং পূর্ব বাহুর মাঝামাঝি আরো অপ্রশস্ত অপর একটি গোপন গলিপথের সংস্থান রাখা হয়েছিল। মাঝখানে ছাদবিহীন চত্বরের সুউচ্চ প্রধান মন্দিরটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এর দক্ষিন কোনের যৎসামান্য অংশ টিকে রয়েছে। উপরের চতুষ্কোন মেরুদণ্ডের প্রত্যেক বাহু ঠেস দিয়ে স্ব-স্ব দিক থেকে যাতায়াতযোগ্য একটি করে পুঁজো ঘর ছিল। প্রতিটি পুঁজোঘর দুই অংশে বিভক্ত।
সামনে ছিল থামওয়ালা একটি মণ্ডপ এবং পিছনে ছিল একটি গর্ভগৃহ। এগুলোর চারপাশে রয়েছে প্রদক্ষিন পথ। তবে নিচের দুটি ধাপে অনুরূপ প্রদক্ষিন পথ ব্যতিত কিছু নেই। ছাদবিহীন চত্বরের বাঁকী অংশে বিক্ষিপ্তভাবে বহু ধরনের বহু ছোট ছোট স্থাপনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে প্রশাসনিক ভবন, নিবেদন স্তুপ, ভোজনশালা, রন্ধনশালা, কুপ, প্রধান মন্দিরের প্রতিকৃতি প্রভৃতি।
নিবেদন স্তুপগুলোর মধ্যে একটির পরিচিতি দাঁড়িয়েছে পঞ্চদেবী। এটি বিহার চত্তরের দক্ষিন-পূর্ব কোনের কাছাকছি অবস্থিত। এখানে একটি নিরেট মঞ্চের উপর একত্রে ৫টি স্তুপ রয়েছে। এর পাশে একটি বাধানো কুপও রয়েছে। তবে নিবেদন স্তুপগুলোর কোনটিরই উপরের অংশ পাওয়া যায়নি।
বিহারের সচল ভালো দিনগুলোতে তীর্থ পর্যটনে আসা বিভিন্ন ভক্তগনের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে পূর্ণকাজ হিসেবে এগুলো নির্মিত হয়েছিল।
ঐতিহ্যবাহী এই বিহারের সকল স্থাপনারই মূল নির্মান উপকরণ ছাঁচে তৈরি পোড়া ইট ও কাঁদামাটি। এছাড়াও পানি নিষ্কাশন নালী, থাম, সরদল, দরজার বাজুবন্ধ, পাদপট্ট প্রভৃতির ক্ষেত্রে বড় বড় সাইজ করা পাথর খণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে।
কারুকাজের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে পিরামিড, শিকল, দন্তপাটি, দাবার ছক, পাকানো দড়ি, বরফি, ফুলেল জ্যামিতিক রেখাচিত্র প্রভৃতি। এছাড়া নিচের ধাপের তলপত্তনে ৬৩টি পাথরের মুর্তি ছিল। নিচে ছিল সারিবদ্ধ পোড়ামাটির ফলক। এসব ফলকে বিবিধ দৃশ্য বিধৃত হয়েছে। দৃশ্যগুলোর মূল উপজীব্য বিহারের সমকালীন লোকায়েত জীবন, জীব-জগৎ, ধর্ম, পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ কাহিনীর খণ্ডচিত্র।

নরওয়ে সরকারের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ব ও যাদুঘর অধিদপ্তরের তত্বাবধানে এখানে ১৯৯৩ সালে যাদুঘর তৈরি হয়। ১৯৯৫ সালে সবার জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। যাদুঘরে দেখা মিলবে প্রাচীন মুদ্রা, সাড়ে ৩ হাজার পোড়া মাটির ফলক চিত্র, সিলমোহর, পাথরের মূর্তি, তাম্রলিপি, শিলালিপি ইত্যাদি।
বিহারের ১২৫নং কক্ষে খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলের রূপার মুদ্রাসহ বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রা কয়েক হাজর পোঁড়ামাটির ফলকচিত্র, পাথরের মুর্তি, তাম্রলিপি, শিলালিপি, বাটখাড়া, শিলনোড়া ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। ১৯৮৩ সালে পাওয়া যায় ব্রোঞ্জের তৈরি একটি আবদ্ধ বৌদ্ধ মূর্তি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারের নকশা সবচেয়ে সেরা। কারো কারো মতে এখানে একটি জৈন মন্দির ছিল। আর সেই মন্দিরের উপরেই গড়ে তোলা হয়েছে এ বিহার। এ বিহারের ১৩-১৪ ফুট আকারের মোট ১৭৭টি ঘর রয়েছে। ঘরগুলোর সামনে টানা বারান্দা। উপরে প্রায় ১০ ফুট চওড়া ছাদ। ঐগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতেন।
বিহারের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি মন্দির। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট এবং প্রস্তে’ প্রায় ৩৫০ ফুট, উচ্চতা ৭০ ফুট। কালের পরিক্রমায় মন্দিরের সবচেয়ে উপরের অংশ ধ্বসে গেছে। এছাড়া আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু স্থাপত্যের নিদর্শন।
এখানে এক সময় যে নদী ছিল তার চিহ্ন দেখলেই বোঝা যায়। নদীর ঘাটটি সম্পর্কে এলাকায় জনশ্রুতি আছে। এই ঘাটে মৈদলন রাজার কন্যা সন্ধ্যাবতী স্নান করতো বলে এ ঘাটের নাম ছিল সন্ধ্যাবতীর ঘাট। একদিন নদীর স্রোতে ভেসে আসা জবা ফুলে ঘ্রান নেয়ার পরে সন্ধ্যাবতী গর্ভবতী হয় এবং পরবর্তীতে ছেলে সন্তান প্রসব করেন।
এখানে প্রতিদিন হাজার-হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটক আসে। পর্যটকরা মূলত কিনতে চায় পাহাড়পুরে ইতিহাস সমৃদ্ধ বই। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাহাড়পুর নিয়ে তেমন কোন ভাল মানের বই নেই। বিদেশী পর্যটকরা ইংরেজী বই চায় কর্তৃপক্ষ দিতে পারে না।
বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ প্রতিনিধি

bhorersanglap