সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া মানুষ
বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের সমালোচকেরা প্রায়শই বলে থাকেন সমাজতন্ত্রের পরাজয় ঘটেছে। ফিদেল কাস্ত্রোর কাছে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হলে তিনি একটি অভিনব জবাব দেন, তিনি বলেন, ‘এখানে সমাজতন্ত্রের পরাজয় নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় পুঁজিবাদের সাফল্য কোথায়?’
তিনি আরও বলেন, ‘সমাজতন্ত্র নিহত হয়েছে’ এই প্রবাদ দিয়ে পুঁজিবাদের জয়জয়কার করা হয়। এই জয়জয়কার কোথায় থাকে যখন এরাই ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, যুদ্ধ সৃষ্টি করছে এবং বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করায় মত্ত হয়ে উঠছে?’
১৯৯১ সালে ম্যাক্সিকান সাপ্তাহিক সিয়েম্প্রেতে পত্রিকাটির ডিরেক্টর বিয়েট্রিজ পেজেসের সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রোর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে মোক্ষম জবাবটি দেন।
বিভিন্ন সময়ে নেওয়া এ রকম তিনটি সাক্ষাৎকার এবং ফিদেলের তিনটি বক্তৃতা বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের পত্রিকা ‘প্রগতি’। এ ছাড়া আরও ফিদেলের রচিত তিনটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এখানে।
যত দিন বেঁচে ছিলেন কাস্ত্রো পৃথিবীর প্রতিবাদী মানুষের মাথার ওপর ছায়া হয়ে ছিলেন তিনি। কখনো নত হননি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে। প্রবল পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র তাঁর প্রতিবেশী, কথিত আছে সে প্রতিবেশী তাঁকে ৬৩৮ বার হত্যা করার চেষ্টা করেছে, প্রতিবারই সেসব চেষ্টা ব্যর্থ করেছেন তিনি। লড়ে গেছেন আমৃত্যু।
তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি এ রকম প্রতিবেশী থাকার পরও এত বছর বেঁচে থাকতে পারবেন। সারা বিশ্বে তিনি কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়েছেন জীবিত অবস্থাতেই। অল্প কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে লড়ে গেছেন মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে। সেই লড়াইয়ে জয়লাভও করেছেন।
ক্ষমতা গ্রহণের পর পাল্টে দিয়েছেন কিউবাকে। পাল্টে দিয়েছেন পৃথিবীর নানা হিসেব। বিশ্বব্যাপী বিপ্লবীদের জন্য এক দারুণ অনুপ্রেরণার নাম ফিদেল কাস্ত্রো।
তার আশি বছর বয়সের সময় বলেছিলেন, ‘৮০ বছরে পৌঁছাতে পেরে আমি সত্যিই খুশি। আমি তা কখনো আশা করিনি, অন্তত এমন প্রতিবেশী পাওয়ার পর ভাবিনি, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর যে প্রতিবেশী প্রতিদিন আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে।’
আসলে মার্কিন মুলুকের জন্য তাদের নাকের ডগায় বসে থাকা এমন প্রতিস্পর্ধী প্রতিবেশী সত্যিই অস্বস্তিকর। যেখানে সারা দুনিয়ায় তারা তাদের প্রভাব খাটাচ্ছে!
কাস্ত্রো বিভিন্ন সময়ে যেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, কথা বলেছেন অত্যন্ত খোলামেলাভাবে। তাঁর এসব কথাবার্তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় তিনি জবাবদিহিতে এবং স্বচ্ছতায় আস্থা রাখতেন। কথা বলতেন প্রাণ খুলে। কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই কখনো কুণ্ঠিত হননি তিনি।
সবিস্তারে প্রসঙ্গকে টেনে নিয়ে গেছেন শেষ অবধি। তাঁর নেতৃত্বগুণ সম্পর্কেও একটি মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় এ সাক্ষাৎকারগুলো থেকে।
কেননা, কথোপকথনগুলোও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করেছেন তিনি। যেমন, বিয়েট্রিজ পেজেসের সাক্ষাৎকারে একপর্যায়ে সাক্ষাৎকারগ্রহীতা নিজেই প্রতিধ্বনি করছেন ফিদেলের কথার, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। পুঁজিবাদের কোনো নৈতিক জয় নেই। কিন্তু এটি আধিপত্য, প্রযুক্তিগত ও সামরিকভাবে একটি সিস্টেম হিসেবে জয় লাভ করেছে। এগুলোর ভেতর ক্ষমতা নিহিত আছে।’
যদিও ২০০৬ সালের পর থেকে কাস্ত্রো জনসমক্ষে তেমন একটা আসতেন না, তবু তিনি যে আছেন, সেটাই এক ভরসা হয়ে মানুষের মনে বাজতো। এমনকি রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেও তার অদেখা অস্তিত্ব মানুষকে সাহস জোগাত। প্রতিবাদী ও ন্যায়বান মানুষকে প্রেরণা দিত তার বেঁচে থাকা।
প্রবল ক্ষমতাবান অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে তাঁর মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা ছিল আসলে আশাবাদের বেঁচে থাকা। ডুবন্ত মানুষের জন্য তিনি যেন ডাঙার হাতছানি। সাম্যবাদের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন আজীবন। নিজের দেশে সেটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ক্ষমতাবান শত্রুর এত কাছে থাকার পরও তারা তাঁর নাগাল পায়নি।
১৯৬৫ সালে লকউড কাস্ত্রোর একটি সাক্ষাৎকার নেন, ‘প্রগতি’ পত্রিকাটি এর অনুবাদ প্রকাশ করেছে। কিউবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় কাস্ত্রোর। ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ফিদেলকে অপসারণের জন্য এক বিদ্রোহের মদদ দেয়। তখনো ব্যর্থ হয় তারা।
কাস্ত্রো তার বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া সকল বিরুদ্ধাচরণ কঠোরভাবে দমন করেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও নিজের দেশে সর্বকালেই জনপ্রিয় তিনি। পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রতিনিধি লকউড এবং কাস্ত্রো দুজন দুমেরুর মানুষও যখন বাক্যালাপে লিপ্ত হন, কাস্ত্রো কথা বলেন রাখঢাক না করেই।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে লকউডের এক প্রশ্নের জবাবে কাস্ত্রো বলেন, ‘আমার মনে হয় এর পেছনে (কিউবায় সরকারের সমালোচনা প্রায় না থাকা) অনেক অবস্থাই দায়ী, কিন্তু মূলত দায়ী জরুরি অবস্থা ও চাপ, যার ভেতর দিয়ে দেশ চলছে, আমাদের প্রথম দরকার খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার জন্য বাকি সব কর্মকাণ্ডই দ্বিতীয় সারিতে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার।’
আমাদের মনে রাখতে হবে সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে ১৯৬৫ তে, যখন কাস্ত্রো শাসনক্ষমতা দখল করেন, তার কয়েক বছর পর। দেশে ভয়ানক অবস্থা বিরাজ করছে, আমেরিকা ও তার মিত্রদের অর্থনৈতিক অবরোধ মোকাবিলা করে সমগ্র কিউবা তখন তার জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর এক প্রাণান্ত সংগ্রামে লিপ্ত।
কাস্ত্রোর বক্তৃতা, যেগুলো অনূদিত হয়েছে পত্রিকাটিতে, দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ক। তাঁর কণ্ঠের সম্মোহন ব্যাপক ও অনিবার্য। ‘প্রগতি’ পত্রিকাটি ১৯৬২ সালের ২ নভেম্বর হাভানায় ‘ফেডারেল উইমেন্স অব কিউবিয়ান’ আয়োজিত জাতীয় কংগ্রেসে নারীর সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে দেওয়া ফিদেলের ভাষণটি প্রকাশ করেছে।
নারীদের উদ্দেশে সেখানে এক দীপ্ত বক্তৃতা দেন তিনি। ফিদেল সেখানে বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, আমরা যেই পৃথিবী গঠনের চেষ্টা করছি সেখানে যেন নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটে।’
ফিদেল কাস্ত্রোকে নিবেদিত পাবলো নেরুদার কবিতাটিসহ আরও কয়েকটি সুপাঠ্য কবিতা প্রকাশ করা হয়েছে পত্রিকাটিতে। ফিদেলের জ্ঞান, তাঁর নেতৃত্ব গুন, সম্মোহনীশক্তি, দৃঢ়তা ইত্যাদির একটি রূপরেখা পাওয়া যাবে ‘প্রগতি’র লেখাগুলোতে।
এ ছাড়া ফিদেলের নিজের লেখা ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে যে তিনটি প্রবন্ধের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটিতে, সেখানে তাঁর চিন্তাভাবনা ও দর্শনের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে পাঠকের। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মতো ফিদেলের এক একটি বাক্যও হয়ে ওঠে অনন্য।
তাঁর কাজ, উদ্যোগ ও বিভিন্ন সময়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলোতে তাঁকে খুঁজে পাবে অনুসন্ধানী পাঠক।
সবশেষে পাঠকের জন্য ফিদেল ক্যাস্ট্রের জীবনীর একটি সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশ করেছে পত্রিকাটি। সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ, বক্তৃতা এবং কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন রবীন গুহ, বিধান রিবেরু, ফাহমি ইলা, মীর মোশাররফ হোসেন, মেহেদী হাসান, দীপংকর গৌতম, সৈয়দ সাখাওয়াত, সুবীর বৈরাগী, খালিদ মাহমুদ সাদ, সাখাওয়াত টিপু এবং অভিনু কিবরিয়া ইসলাম।