বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৪২ বছর ধরে ধাত্রী সেবা দিচ্ছেন আনোয়ারা

ভোরের সংলাপ ডট কম :
মে ২২, ২০১৭
news-image

৪২ বছর ধরে ধাত্রী সেবার কাজ করে যাচ্ছেন আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরী। বাল্যবিয়ের শিকার মাদারীপুরের এই নারী নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সংসার গুছিয়ে ছেলে-মেয়ে লালন পালন করে আজও সমাজের জন্য সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে প্রায় তিন হাজার মাকে ধাত্রী সেবা দিয়েছেন। এসব সেবা তিনি বেশির ভাগই দিয়ে থাকেন বিনামূল্যে।

১৯৫৪ সালের ৩ জুন মাদারীপুর শহরের ৪ নম্বর শকুনি এলাকায় জন্ম আনোয়ারা রাজ্জাকের। বাবা মরহুম চৌধুরী আতাহার উদ্দীন, মা সেতারা বেগম। অস্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাদারীপুর সদর উপজেলা ঝাউদি ইউনিয়নের হোগলপাতিয়া গ্রামের আলহাজ্ব মো. আব্দুর রাজ্জাক মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের পরও স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় চালিয়ে যান পড়াশুনা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন স্বামী আব্দুর রাজ্জাক মিয়াকে। নিজের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংরক্ষণ করে রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন বিভিন্ন সংবাদ। এ খবর পেয়ে পাকসেনারা স্বামী আব্দুর রাজ্জাক মিয়াসহ তাঁর দুই দেবরকে ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন নির্যাতন শেষে তাঁদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এসএসসি ও ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পাস করেন আনোয়ারা। তখন তাঁর স্বামী চাকরি করতেন পৌরসভায়। তিনিও সংসার সামাল দিয়ে একটি বেসরকারি এনজিওতে চাকরি নেন। সেই থেকে নারীদের নিয়ে কাজ শুরু তাঁর। বিভিন্ন নির্যাতিত নারীদের পাশে থেকে তাদেরকে সহযোগিতা করে আসছেন। সাত বছর ঝাউদি ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বার থেকে সমাজের জন্য আরো বেশি কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।

সংসার, চার সন্তান মানুষ করাসহ সামাজিক কাজের পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও করে যাচ্ছেন আনোয়ারা। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘অনেক সাধনার পর’, ‘পদ্মার ঢেউ’ এবং ‘মেঘে ঢাকা তারা’ নামের তিনটি কাব্যগ্রন্থ। সাহিত্য ও ধাত্রী সেবার জন্য পেয়েছেন অনেক সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত গাঙচিল সাহিত্য সম্মাননা, কবি মো. আশরাফ আলী সাহিত্য সম্মাননা, কীর্তনখোলা গাঙচিল সাহিত্য সম্মাননা, জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উৎসব ২০১৫ সালে কবিতা ও চিকিৎসায় বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্ব কবিতা কংগ্রেস মহাসম্মেলনে নজরুল সাহিত্য সম্মাননা, বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি সংস্থা থেকে চিকিৎসা ও কবিতায় অবদানের জন্য সম্মাননা, এশিয়ান র্জানালিস্ট হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড কালচারাল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে সম্মাননা পেয়েছেন।

আনোয়ারা রাজ্জাক জানান, বিনা টাকায় চিকিৎসা সেবা পাওয়ায় লোকমুখে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে মায়েরা তাঁর খোঁজে আসতে থাকেন। দিনে দিনে তাঁর সুনাম ও চাহিদা বেড়ে গেলে নিজ বাড়িতেই ছোট একটা ঘর তোলেন। সেই ঘরেই এখনও চলছে ধাত্রী সেবার কাজ।

সমাজে এ কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে নারীদের নির্যাতনের শিকার হতে দেখেন। তার প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের জন্য মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে নারী উন্নয়ন প্রচেষ্টা নামের একটি সংস্থা খুলে কাজ শুরু করেন। সেইসঙ্গে ‘হাঙার প্রজেক্ট বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক’র মাদারীপুর জেলা শাখার সভাপতি হতে পেরে বেড়ে যায় নারীদের পাশে থাকার সুযোগ।

মাদারীপুর শহরের ২ নম্বর শকুনী এলাকার গৃহবধূ মুন্নি বেগম জানান, শুধু প্রসবকালীন সেবা নয়, নারীদের যে কোনও নির্যাতনের ব্যাপারে এগিয়ে আসেন আনোয়ারা রাজ্জাক। মাদারীপুরের উন্নয়নমূলক সংস্থা নকশি কাঁথার সভাপতি নুরুন্নাহার জুঁই বলেন, “আমি আনোয়ারা রাজ্জাককে চিনি ও জানি। তাঁর কাছে গেলে তিনি নারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহযোগিতা করে থাকেন। বিশেষ করে মায়েদের প্রসবের ব্যাপারে। এ ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাই স্বাভাবিক শিশুর জন্মের ব্যাপারে তিনি সব ধরনের সহযোগিতা করেন। তাই তাঁর প্রতি সবার আস্থা রয়েছে। “

bhorersanglap