শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ছয় মাসে সাগর পথে ইউরোপে ৭৮৯৯ বাংলাদেশি

ভোরের সংলাপ ডট কম :
জুলাই ৩০, ২০১৭
news-image

নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ছয় মাসে ৭ হাজার ৮৯৯ বাংলাদেশি সাগর পথে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ক সংগঠন ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত শুধু ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ৭ হাজার ৮৯৯ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছে।

শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এক পরামর্শ সভায় বক্তারা এ তথ্য জানান।

৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক মানবপাচারবিরোধী দিবস উপলক্ষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক এ সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।

ব্র্যাকের স্ট্র্যাটেজি, কমিউনিকেশনস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক আসিফ সালেহর সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং রামরুর সমন্বয়ক সি আর আবরার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ, সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. শাহ আলমসহ আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বিভিন্ন বিশ্লেষণ তুলে ধরে বলেন, ইউরোপে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ঠিক কত সংখ্যক বাংলাদেশি আছেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে গত এপ্রিলে ঢাকা সফরকারী ইইউ প্রতিনিধিদল ইউরোপে ৮০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশির উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-২০১৫ সাল পর্যন্ত আট বছরে ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এই বছরের ছয় মাস ধরলে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

অনুষ্ঠানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধে আমাদের চমৎকার আইন হয়েছে। একই সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনও হয়েছে। কিন্তু এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ আমরা কতটা করতে পেরেছি তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

তিনি বলেন, পুলিশের তথ্য আনুযায়ী, মানবপাচারের সাড়ে ৩ হাজার মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ জনের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়েছে। এটা সেরকম বড় শাস্তি হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করে তিনি বলেন, অনেক সময় পুলিশ প্রতিবেদন সঠিকভাবে আসে না। সে ক্ষেত্রে আদালতের কিছুই করার থাকে না।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন মনে রাখতে হবে মানবাধিকার রক্ষা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এখানে রাষ্ট্রকেই মূল দায়িত্ব নিতে হবে। আর ছোট অপরাধীদের পরিবর্তে প্রয়োজনে গডফাদারদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

আসিফ সালেহ সভার সুপারিশসমূহ তুলে ধরে বলেন, মানবপাচার রোধে আমাদের মূলত চারটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এগুলো হচ্ছে- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা, সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা, মামলা হলে সেটার সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের সমন্বয়।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জুলাই মাসের শুরুতে তুরস্ক জানিয়েছে, অবৈধ পথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় তুরস্কে গিয়ে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন। ইউরোপের এই চিত্রের পাশাপাশি সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়া এবং সেখানকার গণকবরের কথা চিন্তা করলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে। মালয়েশিয়াও সম্প্রতি অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। অভিযানের প্রস্তুতি চলছে সৌদি আরবেও। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে প্রায় ৪ লাখ বাংলাদেশি বৈধ কাগজপত্র না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে।

অনুষ্ঠানে আরো জানানো হয়, এ বছর মানবপাচার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। এই প্রতিবেদনে দেশগুলোকে তিনটি স্তর বা টায়ারে ভাগ করা হয়। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশকে রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে (টায়ার-টু)। এবার এক ধাপ নামিয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্তরের ‘নজরদারিতে থাকা দেশের তালিকায় (টায়ার-টু ওয়াচ লিস্ট)’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও হংকংসহ ৪৫টি দেশ। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে এবং নিরাপদ অভিবাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে তখন এই চিত্র উদ্বেগজনক।

বক্তারা আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সংস্থার তথ্য তুলে ধরে বলেন, গত চার বছরে প্রায় দেড় লাখ লোক বঙ্গোপসাগর দিয়ে মানবপাচারের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত দেড় হাজার মানুষ সাগরেই মারা গেছেন। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই শতাধিক মরদেহ, যার মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশি।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে মানবপচার দমন ও প্রতিরোধ আইন হওয়ার পর গত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মামলা হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব মামলার অধিকাংশই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি।

bhorersanglap